১লা বৈশাখ ও হালখাতার একাল সেকাল - কলমে সুরজিৎ কোলে

 


১লা বৈশাখ ও হালখাতার একাল  সেকাল

সুরজিৎ কোলে

১লা বৈশাখ দিনটি আমাদের বাঙালিদের ক্যালেন্ডারের পাতায় এক অতীব, ঐতিহ্য মন্ডিত আবেগজড়িত একটি উৎসবমুখর দিন। সেই কবে আকবরের সময়কাল থেকে এই পয়লা বৈশাখের উদযাপন শুরু হয়েছিল। এই পয়লা বৈশাখের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আমাদের হৃদয়ে,সেটি হল পয়লা বৈশাখের দিন বৈশাখী সন্ধ্যায় দোকানে,দোকানে  হাল খাতা করতে যাওয়া।সকাল থেকেই বিভিন্ন মন্দিরে হল খাতা পূজা করানোর সেই চেনা ছবিটা, আজও মনে ফুটে ওঠে। একটা সময় কলকাতা দূরদর্শনে অনুষ্ঠিত হতো পয়লা বৈশাখী আড্ডা ,গান বিভিন্ন জনপ্রিয় শিল্পীদের নিয়ে। সেই অনুষ্ঠান আমরা সকলে টিভির সামনে বসে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতাম।


বড় ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকে মুদির দোকান সর্বত্র এক চিত্র পরিলক্ষিত হত। হালখাতা যেন ক্রেতা,বিক্রেতার মেলবন্ধন ঘটাত। সোনার দোকান থেকে মুদির দোকান সর্বত্রই মালা দিয়ে সুসজ্জিত করে তুলতেন দোকানদারেরা ।সারাবছর খালি গায়ে, লুঙ্গি পরে  মুদির দোকান সামলানো দোকানিকেও  পয়লা বৈশাখের দিন একটু যেন অচেনাই মনে হত।কারণ সেদিন তিনি চোশতা পাঞ্জাবী তে একেবারে ফুলবাবুটি ।


১লা বৈশাখের সন্ধ্যা যেন এক মহামিলনের সন্ধ্যা।সন্ধ্যা হাতেই বেরিয়ে পড়া বিভিন্ন দোকানের আমন্ত্রণে হাল খাতা করার উদ্দেশ্যে। এ এক অপূর্ব অনুভূতি যা অবর্ণনীয়।রাস্তায় বেরোলেই সেই চেনা মনোরম চেনা দৃশ্য যেমন প্রত্যেকের হাতেই মিষ্টির প্যাকেট সহ ক্যালেন্ডার।

দোকান থেকে পাওয়া নববর্ষের নতুন ক্যালেন্ডার ও মিষ্টির প্যাকেট পাওয়া যেন এক পরম প্রাপ্তি। আবার অনেক দোকানদার খারিদ্দারের আপ্যায়নে ঠান্ডা পানীয়েরও ব্যাবস্থা রাখেন।সব মিলিয়ে মিশিয়ে একটা জমজমাট সন্ধ্যা।


বাড়িতে মিষ্টির প্যাকেট ও ক্যালেন্ডার নিয়ে ফিরে এসে অধীর আগ্রহে সেটি উন্মোচন করা। ক্যালেন্ডার পাওয়া মাত্র পরিকল্পনা করা যে ,সেটি ফ্রেমে বাঁধানো হবে না দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখা হবে এবং কবে কোন occasion আছে তা একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া। আর মিষ্টির প্যাকেট থেকে রকমারি মিষ্টির মধ্যে ,নিজের পছন্দের মিষ্টিটা তুলে খেয়ে নেওয়া। প্যাকেট থেকে কে কোন মিষ্টি খাবে ,সেই নিয়ে মাঝে মাঝে ভাই, বোনেদের মধ্যে খুনসুটি চলতো। সারাবছর আমরা যতই মিষ্টি কিনি না কেনো ,হালখাতা করে প্রাপ্ত মিষ্টির স্বাদ একেবারে অন্যরকম।


কিন্তু দুঃখের বিষয় আজকে সবই বিলুপ্তির পথে।হালখাতা ও বাংলা নববর্ষ বর্তমানে আমাদের কাছে আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে যাচ্ছে। আজকের প্রজন্ম জানে না হালখাতার গুরুত্ব বা ঐতিহ্য। আর এর জন্য আর কেউ নয়, দায়ী আমরা নিজেরাই সকলে। ইংরাজী নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে বরণ করে নিতে বিরাট আয়োজন চলে এবং তার সাথে চলে সারারাত হুল্লোড়,বাজি ফাটানো, রাস্তা বেলুন ফিয়ে সাজানো ইত্যাদি। sms পাঠানোর ছড়াছড়ি।অথচ দুর্ভাগ্যের বিষয় বাংলা নববর্ষ কে স্বাগত জানাতে আমাদের এত অনীহা কেন?

এ আমাদের সমগ্র বাঙালী জাতির লজ্জা। আমরা অনুকরণ করতে ,করতে নিজেদের আবেগ,গরিমা,ঐতিহ্যকে ভুলে  কোথায় ছুটে চলেছি আমরা কেউ নিজেরাই জানি না। বাংলা নববর্ষ  নিছকই একটা ছুটির দিন হয়ে গেছে আমাদের কাছে। এটাই কি প্রত্যাশা বাংলা নববর্ষের ,বাঙালিদের কাছ থেকে?



শেষ দুইবছর মহামারি ,লকডাউন আমাদের মধুর স্মৃতিগুলো সব জীবন থেকে কেড়ে নিয়েছে। সেই হালখাতার স্মৃতি এখন বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে।সেই আবেগ আজ আর মনের মধ্যে খুঁজে পাই না, কিন্তু সেটা পাবার প্রবল চেষ্টা করি।বর্তমানে অনেক দোকানদার হালখাতার পুজো বন্ধ করে দিয়েছেন।গত তিন বছর আগেও আমাদের পাড়ার ভোলা বাবু, পাড়ার মোড়ে তার ওই কাপড়ের দোকানে  হালখাতা করার জন্য নিমন্ত্রণ পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু  গত দুই বছরে অতিমারীর প্রভাবে দীর্ঘদিন ব্যাবসা বন্ধ থেকে প্রচুর লোকসান হয়ে,বর্তমানে তিনি তার কাপড়ের দোকানের ব্যবসাটি বন্ধ করে দিয়েছেন।এখন তিনি একটি ফ্লাট বাড়িতে সিকুরিটি পদে কর্মরত।তাই আমার হয়তো আর কোনদিনই ভোলবাবুর দোকানে হালখাতা করতে যাবার অবকাশ রইলো না।


তবুও সর্বোপরি আমি আশাবাদী।আমি মনে প্রানে চাই আমাদের বাঙালিদের জীবনে বাংলা নববর্ষ ও হালখাতা পূর্বের ন্যায় ফিরে আসুক সেই আবেগ নিয়ে। আমি আবারও যেতে চাই  দোকানে ,দোকানে হালখাতা করতে পয়লা বৈশাখি সন্ধ্যায়,একটা মিষ্টির প্যাকেট ও ক্যালেন্ডার যা আবেগে আমার হৃদয়ে একরাশ তৃপ্তির স্মৃতি মনে বিরাজ করবে আমৃত্যু। কারণ নাগরিক জীবনে ব্যাস্ততার প্রভাবে নগরবাসী মানুষ সারাবছর বাঙালি বাঙালী ভাবধারা একপ্রকার ভুলেই গাছে। কিন্তু বাংলা নববর্ষ আমাদের মনে বাঙালীআনার ছোঁয়া দিয়ে যায়। তাই কখনই আমাদের  ভুলে গেলে চলবে  বাংলা নববর্ষ বাঙালির প্রাণের উৎসব। বাংলা নববর্ষ আমাদের জীবনে কেবল মাত্র একটি উৎসব নয় বরং এটি একটি চেতনার  প্রতিরূপক।


আমি তো চাই, বাংলা নববর্ষ আবার পূর্বের ন্যায় স্বমহিমায় ফিরে আসুক। কিন্তু আপনারাও কি তাই চান?? সেটা আগামী সময়ই তার উত্তর দেবে। 

তাই মনের কোণে এই বাসনা নিয়ে,বলি বারবার,

নববর্ষ তুমি ফিরে এসো,মোদের জীবনে আবার।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

close