মধুর পরশ
দেবাশীষ মিত্র
কেমন যেন শিহরণ জাগছিল সমস্ত শরীর জুড়ে। এতবছর পরদেশে ফিরে অতীতটা যে দুহাত বাড়িয়ে ছুঁতে চাইছিল অরিত্রকে। বাড়িটা তেমনই আছে, দীনু কাকার বয়সটাও একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। অরিত্রকে দেখে বাইরে এসে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। "আরে তুমি, কতক্ষন,ভিতরে এস।" স্নেহের উষ্ণতা দীনু কাকার কণ্ঠে। বাড়ির ভিতরে পা বাড়ায় অরিত্র। বাড়ির প্রতিটি ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে জমে থাকা কত ঘটনা কত গল্প যেন মুহূর্তে মুহূর্তে জেগে উঠছিল অরিত্রর সামনে। অরিত্র বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। নিজের মতন করে বাঁচবার স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতো। আর সেই স্বপ্ন নিয়েই আই টি সেক্টরে পা রাখে। সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। বাবা মাকে ভালো রাখবে আর নিজেদের বাড়িটাকে সুন্দর করে সাজাবে এই স্বপ্নে মশগুল ছিল অরিত্র।কিন্তু হায়,মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক। একটা একসিডেন্টে অরিত্রর বাবা ও মা হঠাৎই গত হন।সব স্বপ্ন এলোমেলো হয়ে যায় অরিত্রর। তারপর একসময় চাকরি নিয়ে দেশ ছেড়ে বিদেশের পথে। ছয় বছর পরে আজ দেশের পথে বাড়িটা বেচে আবার কর্মক্ষেত্রে ফিরে যাওয়ার জন্য। খুব তাড়াতাড়িই করতে হবে বিক্রির ব্যাপারটা। বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকে অরিত্র। সমস্ত অতীত যেন উজাড় করে স্মৃতির আঁচল বুলিয়ে যাচ্ছিল অরিত্র দেহ মনের উপর। মায়ের স্নেহ, বাবার আদর সব যেন একাকার হয়ে বাড়িটার মধ্যে জড়ো হয়ে আছে। নিজেকে একটু গুছিয়ে নেয় অরিত্র। না, এসব এখন অচল, আজকের দিনে এসবের কোনো মূল্য নেই। বিক্রি করলে অন্তত এক কোটি। আর তাছাড়া ইউরোপের বিলাস বহুল জীবনকে সরিয়ে এখানে কোনো দিন থাকা সম্ভব নয় অরিত্রর। কাল ই একজন দালালকে নিযুক্ত করবে একমাসের মধ্যে যা করার করতে হবে।
হঠাৎই অরিত্রর চোখ চলে যায় নিচে বাড়ির লাগোয়া বাগানটার দিকে। আরে টগর গাছটা ঠিক সেই আগের মতই আছে। গোলাপের গাছগুলোও সেই একই ভাবে, আর ঐ শিউলি গাছটা.....মায়ের সাথে ভোর বেলায় সেই ফুল কুড়ানোর ধুম, তারপর.....না, আর ভাবতে পারে না অরিত্র।এ বাড়ি তো মায়ের পরশে পূর্ণ,তাকে বিক্রি করে.....জীবনানন্দের "আবার আসিব ফিরে" কবিতাটা কখন যে আবৃত্তি করতে শুরু করেছে অরিত্র তা নিজেও বুঝতে পারেনি।সমস্ত বাড়িটা যেন অপার্থিব আনন্দের বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে চলেছে এখন।কিছু অর্থের বিনিময়ে সব কিছু কি বিক্রি করে দেওয়া যায়? এই বাড়িটার ওপর যে অরিত্রর বড় মায়া জেগে উঠেছে এই মুহূর্তে। প্রতিটা ইটের খাঁজে খাঁজে কত কথা কত স্মৃতি ছড়িয়ে রয়েছে। দেওয়ালের উপর পরম মমতায় হাত বোলাতে থাকে অরিত্র। না কিছুতেই না ,এই অমূল্য রতন কিছুতেই সে অন্যের হাতে তুলে দিতে পারবে না।এই মধুর পরশ অরিত্র কিছুতেই হারাতে পারবে না, বুকের মাঝে হাত রেখে বলে স্মৃতি তুমি ছিলে, তুমি রয়েছ, তুমি থাকবে।
0 মন্তব্যসমূহ
Thanks for your comments.