প্রতিবাদী - প্রলয় কুমার নাথ

প্রতিবাদী

প্রলয় কুমার নাথ

হাসপাতালের বেডের ওপর আধ শোয়া মেয়েটির সামনে ধরে রাখা হয়েছিল একটি বড় আয়না। কম্পমান চোখের পাতাদুটি ধীরে ধীরে খুলে মেয়েটি চেয়ে দেখতে লাগল আয়নার মাঝে নিজের প্রতিবিম্বটার দিকে। বেশ কিছুক্ষণ অবাক নয়নে সে দেখতে লাগল নিজের মুখের প্রতিচ্ছবিটাকে, নিজের দুটো কম্পমান হাত দিয়ে স্পর্শ করেও সে দেখল নিজের মুখের ত্বকটাকে। আবেগে, উত্তেজনায় হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল মেয়েটা। হাসপাতালের ডাক্তার নার্সদের মধ্যে থেকে অপর একটি মেয়ে হাসি মুখে এগিয়ে এলো বেডে বসা মেয়েটির দিকে। তারপর সে মেয়েটির কাঁধে হাত বুলিয়ে বলে উঠল,
---"কেমন লাগল নিজের নতুন চেহারা?"
হাসপাতালের বেডে বসা মেয়েটি কিছু বলতে পারল না, শুধু অপর মেয়েটির দুই হাত নিজের মুঠোর মধ্যে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, তার গলার স্বরে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল অপার কৃতজ্ঞতাবোধ। 
---"এবার নিশ্চয় আর নিজেকে সকলের কাছ থেকে গুটিয়ে রাখবে না তুমি, তাই তো?", প্রশ্ন করল দ্বিতীয় মেয়েটি।
এবারও মুখে কিছু বলে উত্তর দিতে পারল না প্রথম মেয়েটি, শুধু জল ভরা চোখে দ্বিতীয় মেয়েটির দিকে চেয়ে দুদিকে মাথা নেড়ে সে যেন জানাল, "না, আর নিজেকে লুকিয়ে রাখব না আমি!"

*/*/*/*/*/*/*/*/*/*/*/* 

---"উফফ মা! মোচাটা যা রেঁধেছো না…ফাটাফাটি!", শাশুড়ির হাতের রান্না করা ভাত, মোচা চিংড়ি আর ডিমের ঝোল দিয়ে গোগ্রাসে ভাত খেতে খেতে বলে উঠল সুমনা, "দাও…চটপট আরেক হাতা ভাত দাও তো মা!"
সুমনার শাশুড়ি বিমলা দেবী হাসি মুখে ভাতের পাত্র খুলে সুমনার পাতে ভাত দিতে গেলেন, ওদিকে সুমনার স্বামী অসিত খেতে খেতে কৌতুকের স্বরে হেসে বলে উঠল,
---"ইস খাওয়ার ধরণ দেখো…এখুনি গলায় আটকে বিষম খেল বলে!"
---"কি করবো বলো...এদিকে হাসপাতালে যাওয়ার সময় হয়ে যাচ্ছে, ওদিকে মায়ের হাতের এই অপূর্ব রান্না…কোনটা ছেড়ে কোথায় যাই!"
বিমলা দেবী স্বস্নেহে সুমনার মাথায় একটা আলতো চাঁটি মেরে বললেন, 
---"তা ডাক্তার সাহিবা যদি ঘুম থেকে একটু তাড়াতাড়ি ওঠেন, তাহলেই তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়, তাই না…"
বিধবা বিমলা দেবী আর তার পুত্রবধূ সুমনার মধ্যে সম্পর্ক মা মেয়ের মতই। তার ছেলে অর্থাৎ সুমনার স্বামী অসিত ব্যাংকে কর্মরত। আর সুমনা একজন ডাক্তার, শহরের একটি নামী হাসপাতালে সে জেনারেল প্র্যাক্টিশনার, এছাড়াও এম.ডি কোর্স ভর্তি হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। আপাতত সকালের খাওয়া খেয়ে স্বামী স্ত্রী দুজনেরই গন্তব্য হল তাদের কর্মস্থল। বিমলা দেবীর অনেক পুরোনো অভ্যাস ভোরে উঠে রান্না করা, তাই তো তিনি সকাল সকালই ভাত না খাইয়ে ছাড়েন না ছেলে বৌমাকে।
হঠাৎ একটু পরেই বিমলা দেবীর হাস্যোজ্জল মুখটা কেমন যেন শুকিয়ে গেল...তিনি আমতা আমতা করে বলে উঠলেন,
---"ভালো কথা, তোদের তো বলাই হয়নি…কাল প্রমীলাদি ফোন করেছিল…আরে ওই প্রমীলাদি রে, আমার সেই খুড়তুতো দিদি যে বর্ধমানে থাকে…তা তিনি নাকি কিছুদিনের জন্য এখানে ঘুরতে আসছেন…আজ সন্ধ্যার দিকেই চলে আসবেন…"
---"তা এতে তোমার এত চিন্তার কি আছে, মা?", খাওয়া শেষে বেসিনে হাত ধুতে ধুতে বলল অসিত।
---"চিন্তা বলে চিন্তা!…ওই মহিলা কিন্তু ভীষণ জাঁদরেল বলে রাখলাম, খুব পুরোনো ধ্যান ধারণায় বিশ্বাসী...নেহাত খুব নিকট আত্মীয় তাই আর বারণ করতে পারলাম না.."
---"পুরোনো ধ্যান ধারণায় বিশ্বাসী মানে?", বেরোনোর আগে হাতে ঘড়ি পরতে পরতে জিজ্ঞাসা করল সুমনা।
---"আসলে হয়েছে কি জানিস…ওনার সংসারে আছে ওর ছেলে শ্যামল আর বৌমা অনিমা…স্বামী বেশ কিছু দিন হল মারা গিয়েছেন…কিন্তু এছাড়াও ওর একটা মেয়ে ছিল জানিস, তার নাম ছিল সুপর্ণা। মেয়েটা পড়াশোনায় বেশ ভালো ছিল, এম.কমএ খুব ভালো রেজাল্ট করেছিল, তারপর একটা কোম্পানিতে ভালো চাকরিও করছিল। ওর বিয়ে ঠিক হয়েছিল একটি সরকারি চাকুরে ছেলের সাথে.. তারপর কি হল কে জানে, মেয়েটা বোধহয় বিয়ের আগে আগেই অন্য কোন ছেলের সাথে ভেগে গিয়েছিল। এখনো তার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। তারপর থেকে কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল প্রমীলাদি…তার মনে বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গিয়েছিল যে সুপর্ণাকে এতটা শিক্ষিত করা বা বাইরে চাকরি করতে দেওয়াটাই হল তার অন্য ছেলের সাথে ভেগে যাওয়ার পেছনে প্রধান কারণ। তাই এখন তিনি মেয়েদের চাকরি করা বা বেশি শিক্ষিত হওয়া দেখলেই তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠেন!"
---"হয়ে গেল এবার!", সুমনার দিকে তাকিয়ে কৌতুকের সাথে বলে উঠল অসিত, "তার মানে আজ সন্ধ্যা থেকেই শুরু হতে চলেছে ওহি শাশ-বহু ওয়ালা ড্রামা!"
অসিতের কথা শুনে ওরা সকলেই হেসে উঠল, কিন্তু সুমনার মনটা কোন একটা কারণে কেমন খুঁতখুঁত করতে লাগল।

*/*/*/*/*/*/*/*/*/*/*/* 

আজ এমার্জেন্সি ওয়ার্ডে পেশেন্ট ভিড় একটু বেশিই ছিল, তাই কয়েক ঘন্টা ওভারটাইম করতে হয়েছে সুমনাকে। সত্যি বলতে পেশেন্টদের ইসিজি, পালস রেট, ব্লাড প্রেসার দেখতে দেখতে বাড়ির সব কথা ভুলেই গিয়েছিল সুমনা…সে ভুলে গিয়েছিল যে তার বাড়িতে আজ এক অনাহুত অতিথিত আগমন হতে চলেছে। বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় রাত নয়টা বেজে গিয়েছিল সুমনার। তার আগেই অসিত বাড়ি ফিরে এসেছে। বাড়িতে ঢুকেই সুমনার চোখাচোখি হল প্রমীলা দেবীর সাথে। ঘিয়ে রঙের গরদের কাপড় পরিহিতা, পানের রঙে ঠোঁট রাঙানো, বলিরেখা ভর্তি ফর্সা মুখ আর স্থূলকায় চেহারার সেই 'জাঁদরেল' মহিলা তাকে দেখেই ব্যাঙ্গের সুরে বিমলা দেবীর উদ্দেশ্যে সুর করে বললেন,
---"তা হ্যাঁ রে বিমু…প্রতিদিন এমন সময় বুঝি ফেরে তোর বাড়ির বৌমা?"
বিমলা দেবী একটু ইতস্তত করে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই সুমনা বলে উঠল,
---"না না মাসিমা…আজকে একটু কাজের চাপ বেশি ছিল কিনা, আসলে আমার সাথে একই শিফটে থাকা দুজন সহকর্মী আজ আসেনি তাই…", এই কথা বলতে বলতে সুমনা নীচে ঝুঁকে প্রমীলা দেবীকে একটা প্রণাম করতে গেল। তিনি দায়সারা ভাবে সুমনাকে আশীর্বাদ দিয়ে আবার টোন কেটে বলে উঠলেন,
---"বাবাহ, তা আমাদের অসিত তো সেই কোন বিকালেই চলে এসেছে দেখচি…তা পুরুষমানুষের থেকে মেয়ে মানুষের কাজ যে বেশি থাকে তেমন তো কোনোদিন দেকিনি বাপু…"
---"কার কোন দিন কতটা কাজ থাকবে সেটা মেয়ে মানুষ বা পুরুষ মানুষের ওপর নির্ভর করে না মাসিমা", মৃদু হেসে উত্তর দিল সুমনা, "সেটা নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপর। আমি একজন ডাক্তার, কোন মুমূর্ষু পেশেন্টকে ফেলে তো আর চলে আসতে পারি না…আর বাকি রইল অসিতের কথা...ওর আজকে ব্যাঙ্কে হাফ ডে ছিল তাই…"
---"আরে এই তো সবে ফিরলি রে…আগে হাতমুখ ধো, তার পর হবে সব কথা…যা গিয়ে ফ্রেস হয়ে নে, আমি তোদের রাতের খাবার বাড়তে যাই", তৎপর হয়ে বলে উঠলেন বিমলা দেবী, যেন চেষ্টা করতে চাইলেন পরিস্থিতিটাকে একটু হালকা করতে। 
সুমনা নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল, কিন্তু যেতে যেতে পেছন থেকে শুনতে পেল প্রমীলা দেবী ফিসফিসিয়ে বিমলা দেবীর কানে কানে বলছেন,
---"ডাক্তার বলে বড্ড অহংকার ওই বেটির, তাই না? আমার মুখে মুখে চোপা! ওর ওই গুমোট যদি আমি না ভেঙেছি তো আমার নাম প্রমীলা নয়!"

*/*/*/*/*/*/*/*/*/*/*/* 

সেদিন রাতে শুয়ে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল সুমনার মনে। প্রমীলা দেবীর সম্বন্ধে সকল বিবরণ সে বিমলা দেবীর কাছে থেকে আগেই শুনেছে…স্বর্গীয় হিরন্ময় ব্যানার্জির স্ত্রী প্রমিলা ব্যানার্জি, বাসস্থান বর্ধমানে…ছেলে শ্যামল ব্যানার্জি, পুত্রবধূ অনিমা ব্যানার্জি…আর মেয়ে সুপর্ণা ব্যানার্জি…তাহলে ও যেটা ভাবছে সেটাই ঠিক!! উত্তেজনায় রাতে অনেক দেরিতে ঘুম এলো সুমনার দুই চোখে। এবং বলা বাহুল্য সেই ঘুম ভাঙলো সকালে ওদের বেডরুমের বাইরে থেকে আসা প্রমীলা দেবীর সুর করে বলা কথাগুলোর আওয়াজ শুনে। 
---"হ্যাঁ রে বিমু…এ কেমন লক্ষ্মীছাড়া বউ হয়েছে তোর…বাড়ির বউ, কোথায় সাতসকালে উঠে স্নান সেরে সকলের জন্য চা জলখাবার বানিয়ে রেডি করে তোদের ঘুম থেকে ডেকে তুলবে..তা না, তাকেই তো দেখছি তোকে ঘুম থেকে তুলে খাওয়াতে হবে…"
---"আহ দিদি ছাড় না…মেয়েটা সারাদিন বাইরে বাইরে এত খাটাখাটনি করে, আবার এম.ডিতে ভর্তি হওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে…তা আমি না হয় খাওয়ালামই ওদের চা বানিয়ে...যে কটা দিন পারি করি না.."
ঠিক এমন সময় রান্না ঘরে ঢুকল সুমনা। সে মুখে হাসি এনে বলল,
---"মা, মাসিমা…আপনারা যান, ঘরে গিয়ে বসুন...আমি চা বানিয়ে নিয়ে যাচ্ছি…"
---"উহ ঢং…তার জন্য সাত সকালে উঠতে হয় বাছা…তোমার শাশুড়ি মা প্রায় সেরেই ফেলেছে সব কাজ…শুধু কি চা, তোমাদের জন্য এক প্রস্থ রান্নার সরঞ্জামও তার রেডি…এই বয়সেও মানুষটাকে এত খাটিয়ে নিজে পড়ে পড়ে ঘুমোতে ভালো লাগে তোমার?"
নাহ, এই মহিলা সত্যিই অত্যাধিক ঝগড়াটে। আর সহ্য করতে পারল না সুমনা। অতি শান্ত অথচ দৃঢ় গলায় সে বলে উঠল,
---"আপনাকে কে বলেছে আমি মা কে অনাদর করি? আমি কি কখনো তাকে জোর করেছি রান্নার কাজ করতে? আসলে কি জানেন মাসিমা…পৃথিবীতে নানা মানুষ নানা কাজ করতে ভালোবাসে…একেক জন একেক রকম কাজ করে আনন্দ পায়…এই যেমন মা সকলকে যত্ন করে নিজের হাতের রান্না খাইয়ে তৃপ্তি পায়…আবার কেউ কেউ এমনও আছে যারা অন্যের দোষ ধরে কথায় কথায় ঝগড়া বাধিয়ে শান্তি পায়, এই যেমন আপনি!"
প্রমীলা দেবীর চোখে চোখ রেখে এই কথা বলে সেখান থেকে চলে গেল সুমনা। সে আন্দাজ করতে পারল রাগে লাল হয়ে উঠেছে প্রমীলা দেবীর মুখ। বিমলা দেবী ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে যাচ্ছিলেন তাকে শান্ত করার, কিন্তু তিনি ভৎসনার সুরে তাকে বলে উঠলেন,
---"দেখেচিস তো বিমু, দেখ…মেয়েমানুষকে বেশি নেকা পড়া করালে, চাকরি করতে দিলে কেমন মাথায় ওটে দেখ…এই মেয়ে কিন্তু একদিন তোর মাতায় উঠে নেত্য করবে এই আমি বলে রাখলুম, হ্যাঁ!"
এমনিতেই সকাল সকাল এই ধরণের পরিস্থিতি দেখে মেজাজটা খিঁচড়ে গিয়েছিল সুমনার। তার ওপরে আজকে আবার বেশ দেরি হয়ে গিয়েছে। এখন কোন রকমে একটু নাকে মুখে দিয়েই তাকে ছুটতে হবে। শুধু হাসপাতালে নয়, ফিরতি পথে অন্য একটি জায়গাতেও যেতে হবে তাকে। সেই কথা ভাবলেই উত্তেজনায় ঘামতে শুরু করল সে। আজ আর ভালো লাগল না শাড়ি পরতে, এমনিতেই আজকে উইকেন্ড, তাই আলমারি থেকে একটি জিন্স আর টপ বার করে ঝটপট পরে তৈরি হয়ে নিল সে। কিন্তু এই পোশাকে প্রমীলা দেবীর সামনে যেতেই যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হয়ে গেল।
---"ছি ছি ছি…এই শিক্ষে দিয়চে তোমার বাপ মা…এ কেমন ধারা পোশাক পরেছ তুমি, হ্যাঁ? হায় ঈশ্বর এমন দিনও দেখতে হল আমায়…", তারস্বরে চিৎকার করে উঠলেন তিনি, "বলি এই ভাবে রাস্তায় গতর দেখাতে দেখাতে চলবে তুমি? এইবার বুঝলাম, এই জন্যই পাড়ার ছেলে ছোকরাগুলো মেয়েদের দেখলেই খারাপ কাজ করতে যায়…"
অবাক হয়ে যাচ্ছিল সুমনা, কি অত্যাধিক নিম্ন রুচি এই মহিলার! নিজে একজন মেয়ে হয়েও কি অবাস্তব চিন্তা ভাবনা। সুমনা যতই চেষ্টা করে এই মহিলাকে এড়িয়ে যেতে, ইনি ততই ওকে বাধ্য করেন প্রতিবাদ করতে।
---"শাড়ি পরলেই বুঝি গতর সুরক্ষিত থাকে, তাই না মাসিমা? আর জিন্স টপ পরলেই বুঝি পাড়ার ছেলেদের উত্তেজিত করা হয়, তাই তো? কিন্তু আমি তো জানি শাড়িতেই বরং শরীরের বেশ কিছু অংশ অনাবৃত থাকে, যা এই পোশাকে থাকে না!…তাছাড়া আপনি একবার হলফ করে বলুন তো, আজ অবধি মেয়েদের সাথে যত 'খারাপ কাজ' ছেলেরা করেছে তা শুধু এই পোশাকের মেয়েদের সাথেই হয়েছে? শাড়ি পরা মেয়েরা বেঁচে গেছে? তা কিন্তু নয় মাসিমা…শুধু শাড়ি নয়, সর্বাঙ্গ বোরখায় ঢাকা মহিলারাও ছেলেদের 'খারাপ কাজের' শিকার হয়েছে…এমনকি দুধের শিশুরা অবধি…আসলে কি জানেন, 'খারাপ কাজ' করতে একটা বিকৃত মস্তিষ্কের প্রয়োজন হয়, যা কখনোই কোন মেয়ের পোশাকের ওপর নির্ভর করে না!"
---"এই তুই যা তো, কাজে যা…এইবেলা বুঝি দেরি হচ্ছে না…", সুমনাকে এই দৃশ্য থেকে বার করে আরো একবার ওদের ঝগড়ার ইতি টানতে চাইলেন বিমলা দেবী। অসিতের সাথে বেরিয়ে পড়ল সুমনা, কিন্তু যেতে যেতে শুনতে পেল প্রমীলা দেবী দাঁত কিড়মিড় করে বলছেন,
---"এই যদি হত না আমার বাড়ির বউ, তাহলে ঐ হতচ্ছারীর চুলের মুঠি ধরে দিতাম এক ঘা।"
কথাটা শুনেই ঝপ করে দাঁড়িয়ে পড়ল সুমনা। পেছনে ঘুরে সে কিছু বলতেই চাইছিল, এমন সময় অসিত তার হাত চেপে ধরল।
---"লিভ হার সুমনা…কিছুদিনের জন্য এসেছেন উনি, দুদিন বাদেই চলে যাবেন...", অসিতের গলায় অনুনয়ের সুর। সেই যাত্রায় নিজেকে সংযত করে নিল সুমনা, কিন্তু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল…আর নয়, আজ রাতেই শায়েস্তা করতে হবে এই মহিলাকে।

*/*/*/*/*/*/*/*/*/*

সেদিন সন্ধ্যায় মায়ের অনুরোধে প্রমীলা দেবী এবং তার ছেলে বৌমার জন্য শাড়ি, জামা প্যান্ট ইত্যাদি কিনে বাড়ি ফিরেছিল অসিত। আসলে এই মহিলাকে কোন উপহার দেওয়া তো দূরের কথা, অসিত চায় না যে ইনি আর একদিনও এই বাড়িতে থাকুন, কিন্তু মায়ের কথা সে ফেলতে পারেনি। আসলে এতদিন পরে তিনি এই বাড়িতে এলেন, তাই তাকে কিছু না দিলে খুব খারাপ দেখায়। উপহারগুলো পেয়ে বড্ড খুশি হলেন প্রমীলা দেবী। বারবার ওগুলোকে উল্টে পাল্টে দেখে খুব পছন্দ হওয়ার প্রমাণ দিতে লাগলেন। এমন সময় কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বাড়িতে প্রবেশ করল সুমনা।
---"এই দেখো দেখি, তোমার সোয়ামী আমার আর আমার ছেলে বৌমার জন্য কত কিছু কিনে এনেছে…বাহ, চোখের মাপ আছে বলতে হবে আমাদের অসিতের!", বিদ্রুপের ভঙ্গিতে প্রমিলা দেবী বলতে লাগলেন, "তা তুমিও তো নাকি ডাক্তারনি…নিশ্চয় অনেক ট্যাকাই রোজগার কর..তা সংসারে দাও কোন পয়সা? নাকি সবটাই বাপের বাড়ি গিয়ে ঢেলে আসো?"
---"না, আমার মাইনের বেশিরভাগটাই অন্য কাজে খরচা হয়ে যায়, মাসিমা!", প্রমিলা দেবীর চোখে চোখ রেখে বলতে লাগল সুমনা, "তাই না তো এই সংসারে কিছু ঢালতে পারি, না বাপের বাড়িতে…"
কিছুক্ষন অবাক হয়ে সুমনার দিকে তাকালেন প্রমীলা দেবী, তারপর বললেন,
---"ও মা গো! তা কোন কাজে তোমায় সব টাকা নেগে যায় শুনি! তাহলে কি বুঝবো আমার সুপুর (সুপর্ণার) মত তোমারও কোন গোপন নাগর জুটেছে! তার পেছনেই খরচা কর নাকি ট্যাকাগুলো?…বিমু, আমি তোকে বলে রাখলুন…এই মেয়েও একদিন আমার সুপুর মত পরিবারের নাক কেটে কোন মিনসের সাথে ফুড়ুৎ হল বলে!!…সেই জন্যই যখন অনিমা (প্রমীলার পুত্রবধূ) এম.এ পড়ার কথা বলেছিল, পড়া লেখা করে চাকরি করার কথা বলেছিল…আমি পষ্ট করে বলেছিলুম ওসব করতে হলে এই বাড়ির বাইরে গিয়ে করো…আরে যখন তোর বর (প্রমীলার ছেলে শ্যামল) ইঞ্জিনিয়ার, তখন তোর চাকরি করার দরকার কি হ্যাঁ? আসলে জানিস তো বিমু, মেয়েমানুষকে চাকরি করতে বাড়ির বাইরে যেতে দিলেই সে বারোভোগ্যা হয়ে ওঠে…"
---"সুপর্ণাআআআআ…", প্রমিলা দেবীর কথার মাঝে চিৎকার করে উঠল সুমনা। 
আর ঠিক তখনই বাড়ির খোলা দরজা দিয়ে অত্যন্ত কুন্ঠিত হয়ে ভেতরে ঢুকলো সুমনার বয়সী আরেকটি মেয়ে। তাকে দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে চমকে উঠলেন প্রমীলা দেবী। মেয়েটি সুশ্রী কিন্তু তাও কেমন যেন একটা হালকা বিকৃতির ছাপ রয়েছে তার মুখের ত্বকে। 
---"এই আপনার সুপর্ণা, তাই তো মাসিমা", শান্ত নম্র কণ্ঠে বলতে শুরু করল সুমনা, "আপনার মেয়ে কিন্তু কোন নাগরের সাথে পালিয়ে যায়নি মাসিমা, বরং তার সেই নাগর এমন ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটিয়েছিল তার সাথে, যা শুনলে আপনি আঁতকে উঠবেন। সুপর্ণা হয়তো লজ্জার খাতিরে আপনাকে কিছুই জানায়নি। চাকরির খাতিরে কলকাতার ভাড়া বাড়িতে থাকতে হত সুপর্ণাকে। অফিসে যাওয়ার পথে প্রায়শই একটি রাস্তার ছেলে ওকে উত্যক্ত করত। প্রণয় নিবেদনের চেষ্টা ব্যর্থ হলে, সে শুরু করেছিল নানা রকমের টোন টিটকারি এবং অশালীন কথাবার্তা। কিন্তু তাতেও যখন তেমন আমল দিত না সুপর্ণা, তখন একদিন অফিসে যাওয়ার পথে সেই ছেলেটি ওর মুখে acid ছুঁড়ে মারে। রাস্তায় পড়ে যন্ত্রনায় কাতরাতে থাকে মেয়েটা কিন্তু কেউ তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি। আমরা কয়েকজন মহিলা ডাক্তাররা একসাথে একটি গাড়ি রিজার্ভ করে প্রতিদিন হাসপাতালে যাই। সৌভাগ্যক্রমে সেদিন আমাদের গাড়িটা রাস্তায় ছটফট করতে থাকা ওর সামনে এসে পড়ে। আর দেরি না করে ওকে আমাদের হাসপাতালে নিয়ে যাই আমরা, সেখানে ওর চিকিৎসা করাই। কিন্তু সুস্থ হওয়ার পর ও নিজের চেহারা দেখে ডিপ্রেশনে ভুগতে থাকে, কারণ ওই acid এর ছোঁয়ায় ওর মুখের ৭০% ঝলসে গিয়েছিল।"
ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে সুপর্ণা। একবার দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করে সুমনা,
---"এবার আপনাকে বলবো, আমার উপার্জনের টাকা এই সংসারে না দিয়ে আমি কোথায় দিই। আমরা কয়েকজন মহিলা ডাক্তার মিলে একটি এন.জি.ও চালাই, সেখানে মূলত সমাজের পিছিয়ে পরা হতভাগ্য মেয়েদের আশ্রয় দেওয়া হয়। নিজের ওই বীভৎস চেহারা নিয়ে আপনার কাছে ফিরে যেতে চায়নি সুপর্ণা…সে চেয়েছিল চেনা জানা সকলের থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে। তাই কিছুদিনের জন্য ওকে আমরা রেখেছিলাম ওই নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে। নিজেদের কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে আমরা ওর চিকিৎসা করাই একজন নামজাদা স্কিন সার্জেনের কাছে। প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে আজ নিজের ৯০% রূপ আবার ফিরে পেয়েছে সুপর্ণা, বাকি যেটুকু পোড়া চিহ্ন রয়ে গিয়েছে ওর ত্বকে সেটা হয়তো যাবে না, কিন্তু আগের থেকে অনেকটাই স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে ও। সার্জারি সাকসেসফুল হওয়ার পর ও আপনার কাছে ফিরে আসতে চাইল…তাই যখন সে আপনার এবং আপনার পরিবারের নাম ঠিকানা আমাকে বলল, তখন সেটা শুনে চমকে উঠলাম আমি। বুঝতে পারলাম যে ও আপনারই সেই হতভাগ্য মেয়ে যাকে কোন ছেলের সাথে পালিয়ে যাওয়ার মিথ্যা ভাবনা ভেবে সকল মেয়েদের পড়াশোনা আর চাকরির বিরুদ্ধে চলে গিয়েছেন আপনি! তাই তো হাসপাতাল থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে ওই নারী পুর্নবাসন কেন্দ্রে গিয়ে ওকে সাথে করে নিয়ে আসলাম আমি!"
সকলকে অবাক করে হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন প্রমীলা দেবী। তিনি ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন সুপর্ণাকে। তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সুমনার দিকে জলভরা চোখে চাইলেন তিনি...সেই চোখে এখন আগেকার ঔদ্ধত্য আর নেই, রয়েছে ক্ষমা প্রার্থনা আর কৃতজ্ঞতা বোধ।
---"সুপর্ণা আবার ফিরে পেতে চলেছে তার চাকরি, ওর কোম্পানি সেটা লিখিত ভাবে জানিয়েছে…আর যে ছেলেটি ওর এতবড় সর্বনাশ করেছিল, তাকেও এরেস্ট করেছে পুলিশ.. উপযুক্ত আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে তার বিরুদ্ধে!", বলেই চলল সুমনা।
পরদিন সকালে সুমনার ঘুম ভাঙলে তার সামনে চা নিয়ে হাজির হলেন স্বয়ং প্রমীলা দেবী। সুমনার হাতে চায়ের কাপ দিয়ে তিনি বললেন,
---"আজ আর তোমার শাশুড়ি নয়, আমি নিজে হাতে তোমার পছন্দের সব পদ রান্না করেছি মা....তুমি চা খেয়ে স্নান সেরে খাবে এসো…আর পারলে আমায় ক্ষমা করো মা...এই কদিন তোমার সাথে আমি যা ব্যবহার করেছি…"
তার কথা শেষ না হতেই সুমনা বলল,
---"আজ যদি কাকতালীয় ভাবে সুপর্ণাকে এইভাবে সাহায্য না করতাম আমি…তাহলেও কি আপনার মনের ভাবে এতটা পরিবর্তন আসত, মাসিমা? নিশ্চয় নয়...তাই আমি আপনাকে ক্ষমা তখনই করবো যখন আপনি শুধু আমার ক্ষেত্রেই নয়…আপনার চেনা পরিচিত সকল মেয়েকেই উচ্চশিক্ষিত এবং স্বাবলম্বী করে তুলতে উৎসাহী হবেন…তখনই সফল হবে আমার প্রতিবাদ।"
সুমনার কথা শুনে বোবার মত দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রমীলা দেবী। পরে সেইদিন হাসপাতাল থেকে ফিরে সুমনা জানতে পেরেছিল যে সেদিন দুপুরেই মেয়েকে নিয়ে প্রমীলা দেবী বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। 

*/*/*/*/*/*/*/*/*/*/*/* 

এরপর প্রায় দুই বছর কেটে গিয়েছে। সেদিন ছুটি নিয়েছিল সুমনা। বিমলা দেবীকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে মাংসটা নিজেই রাঁধার প্রস্তুতি নিচ্ছিল সুমনা। এমন সময় হঠাৎ সেই বাড়িতে হাজির হল সুপর্ণা। তার মুখশ্রী এখন যেন আরো একটু স্বাভাবিক। তবে তার সাথে আরেকটি মেয়ে এসেছে, সে সুপর্ণারই বয়সী। সুপর্ণা সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল অপর মেয়েটিকে...সে হল তার বৌদি অর্থাৎ প্রমীলা দেবীর বৌমা, অনিমা। সকলকে অবাক করে অনিমা টুক করে একবার প্রণাম করল সুমনাকে, তারপর কৃতজ্ঞতার স্বরে তাকে বলল,
---"মায়ের মুখে শুনেছি তোমার কথা দিদি…তুমি মায়ের মনটাকে একেবারে পাল্টে দিয়েছো। তাই তোমার জন্যই আমি আজ এম.এ কমপ্লিট করতে পারলাম, একটা প্রাইভেট স্কুলে চাকরিও পেয়েছি। মা কিন্তু তাতেও সন্তুষ্ট নন, তিনি চান আমি বি.এডএ ভর্তি হই, তারপর সরকারি স্কুলে চাকরির জন্য চেষ্টা করি...তাই আজ একবার কলকাতায় এসেছিলাম এখানকার একটা কলেজ থেকে বি.এডএর ফর্ম তুলতে…"
স্বপ্ন পূরণের খুশি ঝিলিক দিয়ে উঠছিল অনিমার দুই চোখে। সুমনার মুখেও ছিল অপার প্রশান্তি…যাক, এতদিনে তার প্রতিবাদ সফল হয়েছে । 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

close