সুখ পাখি (ধরা সহজ নয়)
রাখী সরকার
তন্ময় সুলেখার মোবাইলটা কেড়ে খাটের ওপর ফেলে দেয়।
রুক্ষ স্বরে সুলেখাকে বলে,--আমি তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করছি। কার বাইকের পেছনে তুমি ঘুরে বেড়াও, আমি না থাকলে।
সুলেখার গলায় অবহেলার সুর ওঠে।
-তাও শুনে ফেলেছো। তোমার হতচ্ছাড়া বন্ধুদের আমার ওপর নজর রাখা ছাড়া কি কোন কাজ নেই। নিজেদের বউ সামলাতে বল।
তন্ময় দাঁতে দাঁত চেপে বলে…
-আমার বন্ধুদের দোষ দিচ্ছো কেন? নিজে তো পর পুরুষের সাথে ঘুরে বেড়াও এটা তো সত্যি তাই না।
-পর পুরুষ নয় সম্রাট আমার বন্ধু।
-বন্ধু না প্রাক্তন প্রেমিক।
-বন্ধু… প্রেমিক... যা বলছ সব। কী করবে তুমি।
-সুলেখা এখনো ঠিক হও বলছি, নয় তো আমার থেকে বেশি খারাপ আর কেউ হবে না।
-শোনো আমাকে ওসব ভয় দেখাবে না।
-হ্যাঁ... , সত্যিই তো…………… তুমি ভয় পাবে কেন? ভয়তো আমার আছে। তোমার ওই দু নম্বরী প্রেমিকের কাছ থেকে।
বাবা মায়ের অমতেই সুলেখাকে বিয়ে করেছিল তন্ময়। প্রথম দু'বছর ভালই ছিল। যতদিন ওরা একসাথে ছিল। চাকরির ট্রান্সফার শিলিগুড়িতে দেওয়ার পর থেকেই সুলেখা আলিপুরের বাড়িতেই থাকে। নিজের এলাকা ছেড়ে ও শিলিগুড়িতে একা একা থাকতে চায়নি। আর সেই কারণে তন্ময় ও আর জোরজার
করে নি।
কিন্তু তন্ময়ের অনুপস্থিতিতে সুলেখার প্রাক্তন প্রেম আবার জেগে উঠে। তন্ময়ের সাথে প্রেমের সম্পর্কের আগে সম্রাটের সাথে সুলেখার একটা ঘনিষ্ঠ প্রেমের সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সম্রাট প্রেমে এতটাই অন্ধ হয়ে গিয়েছিল, যে নিজের ভবিষ্যৎ গড়ার কথা ভুলেই গিয়েছিল।
ফলে সুলেখা টুপ করে সম্রাটকে ছেড়ে দিয়ে ঝুলে পড়লো তন্ময়ের ঘাড়ে। ভালো ব্যাংকে চাকরি করা সুদর্শন ছেলে, একটা নিশ্চিত ভবিষ্যত, এসব দেখে সুলেখাই ল্যাং মেরেছিল সম্রাট কে?
ওদিকে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে এতদিনের বিছানা গরম করা প্রেমিকাকে হারিয়ে সম্রাটের তো রইরই অবস্থা । সম্রাটের জেদ চড়ল। সেও কিছু করে দেখাবে। তাই বছর দুয়েকের মধ্যেই সুপারির ব্যবসা আরো দুনম্বরী দু'চারটে ব্যবসা করে বেশ গুছিয়ে নিয়েছে।
একটা বুলেট নিয়ে সকাল-বিকেল সুলেখার বাড়ির সামনে রাস্তা দিয়ে চক্কর কাটাই ছিল সম্রাটের জীবনের প্রত্যেক দিনের রুটিন।
বারবার চোখের সামনে প্রাক্তন প্রেমিককে আবার দেখতে দেখতে পুরাতন প্রেম টাও আবার জেগে উঠলো। তার ওপর ত্রিশ বছরের যুবতীর শারীরিক ক্ষুধা।হয়তো সেই ক্ষুধা নিবারণের জন্য তন্ময়ের থেকে সম্রাটই সঠিক লোক ছিল। শুরু হয়ে গেল স্বামীর চক্ষুর আড়ালে পুরাতন প্রেমের রিভিশন।
সুলেখা সম্রাটের বুকে মুখ গুঁজে ওর বুকের ঘ্রাণ নিতে নিতে বলল- "আমাকে বিয়ে করবি ? "
সম্রাট হয়তো এই প্রশ্নটা জন্যই এতদিন অপেক্ষা করছিল। সম্রাটের গলায় আবেগের সুর।
-সত্যি বলছিস লেখা ! তুই আমায় বিয়ে করবি?
-হ্যাঁ আমি শুধু তোর সাথেই থাকতে চাই ।এভাবে দিনের পর দিন ঝগড়া অশান্তি আমার আর ভালো লাগেনা।
-তাহলে এবার তন্ময় আসলে, তুই ডিভোর্স চাইবি ওর কাছে।
-হ্যা তাই বলবো।
-তারপর আমরা বিয়ে করে একসাথে থাকব। আমায় কেন ছেড়ে গিয়েছিলিস বাবু ? জানিস না তোকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না। সম্রাট স্নেহের চুম্বন আঁকে সুলেখার কপালে।
সুলেখা আবার নতুন শুরুর স্বপ্ন বুনতে ডুবে যায় সম্রাটের শরীরের মধ্যে। একটা সুখ পাখির স্বপ্ন।
তন্ময় প্রতি সপ্তাহে বাড়ি ফিরলেও,গত দুই সপ্তাহ বাড়ি ফেরেনি। আর বাড়ি ফিরলেই শুরু হয়ে যায়,দুজনের চরম অশান্তি। তন্ময় ও ভেতর থেকে ভাঙছিল। সুলেখা গলা তুলে বলে -আমি তোমার সাথে আর থাকতে চাই না।
তন্ময় বেশ অবাক হয় ,-মানে ? থাকতে চাও না মানেটা কি?
-আমি ডিভোর্স চাই।
-ডিভোর্স চাও?
-হ্যাঁ, আমি তোমার সাথে আর থাকব না।
-এর মধ্যে শখ মিটে গেল!! খেলার পুতুল মনে করো নাকি ছেলেদের? কদিন খেললে আর ভালো লাগছে না আর থাকবে না।
-তোমাকে পছন্দ করাটাই আমার ভুল ছিল ।
-ভুল তো আমার ছিল, সব জেনেও তোমাকে বিয়ে করেছিলাম।
-হ্যাঁ, এখন বুঝতে পেরেছ তো ভুলটা !তবে এবার ডিভোর্সটা দিয়ে দাও।
-এত সোজা ? তুমি আমার জীবনটা নষ্ট করে দিয়ে নিজে নতুন করে শুরু করবে আমি তোমাকে যেতে দেব।
-আমাকে আটকে রাখতে পারবে তুমি...?
-না, আমি তোমার বাড়ির লোককে বলবো ,আমি ক্লাবে জানাবো।
-আর আমি যদি সবার সামনে বলি তুমি কিছু করতে পারো না, তাই আমি তোমার সাথে থাকতে চাইছি না সম্মানটা থাকবে তো তোমার।
-এত বড় মিথ্যা কথা বলতে পারবে তুমি ?
-আমাকে তুমি না ছাড়লে আমি সব পারবো।
সুলেখা দেখলো তন্ময়ের হাতের মোবাইলের ক্যামেরা অন ছিল।সুলেখা চিৎকার করে উঠলো। তুমি রেকর্ডিং করছিলে ?
-হ্যাঁ, করেছি তুমি বেশি চালাক না, আমি তোমাকে ডিভোর্স দেবো না ।
-তুমি ডিভোর্স না দিলেও,আমার সম্রাটের কাছে যাওয়া আটকাতে পারবে ?
--আমি তোমাকে আমার সম্মান নিয়ে খেলতে দেবো না সুলেখা। এখানে আমার আমার পরিবারের একটা সুনাম আছে।
এভাবেই দিনের-পর-দিন মাসের-পর-মাস সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজে পাচ্ছিল না সুলেখা।প্রায়ই জোর করেই সুলেখাকে শিলিগুড়ি নিয়ে যেত তন্ময়।সম্রাটের সাথে সুলেখার দেখাটাও কম হতে লাগলো।
সুলেখার চোখের জল সম্রাটকে দিন দিন নৃশংস করে তুলছিল।সুলেখাকে নিজের কাছে পাওয়ার জন্য সম্রাট হিংস্র হয়ে উঠলো ।
তন্ময় মাঝেমাঝেই সপ্তাহের মাঝখানে বাড়ি চলে আসে সুলেখাকে পাহারা দেওয়ার জন্য। তেমনিই একদিন বাড়ি ফিরে দেখে সুলেখা বাড়িতে নেই। রাত নটায় বাড়ি ফেরে সুলেখা। তন্ময়ের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেল সেদিন।
সুলেখাকে টেনে দুটো চড় কষিয়ে দিয়েছিল তন্ময়। সুলেখা রাগ করে ওর বাবার বাড়িতে চলে গিয়েছিল।
রাতের পর রাত জেগে ছাদে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়েছে তন্ময়।
দিন পনেরো পর তন্ময় সুলেখাকে নিতে পৌঁছে গেল শ্বশুর বাড়িতে। সুলেখার কাছে ক্ষমা চেয়ে আবার ফিরিয়ে নিয়ে এলো বাড়িতে। পুরুষের মেরুদন্ড শক্ত না হলে নারীরা হয়তো তাদের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেনা।
তেমনই তন্ময়ও হয়তো সুলেখার চোখে মেরুদণ্ডহীন পুরুষে পরিণত হয়েছিল।
সুলেখাকে সম্রাট কথা দিয়েছি এবার সে কিছু করবেই।সুলেখাকে তন্ময়ের সাথে ভালো ব্যবহার করতে পরামর্শ দিয়েছে। সম্রাটের কথামতোই সুলেখা তন্ময়ের সাথে এখন ভালো ব্যবহার করে।
দুজনের মধ্যে আবার চার বছর আগের নতুন প্রেম প্রেম গন্ধ ভাসতে শুরু করেছে ।তন্ময় সুলেখার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল
- চলো কোথাও ঘুরে আসি।
সুলেখার মুখে মিষ্টি হাসি।
- জয়ন্তী যাবো।বক্সা জঙ্গলের রাস্তা টা আমার খুব ভালো লাগে। বিয়ের আগেও তো আমরা কতবার ওখানে গিয়েছি।
-তন্ময় বলল ,ঠিক আছে আমরা কাল জয়ন্তীতে যাব। তন্ময় ঘুমিয়ে পড়লে সুলেখা সম্রাটকে মেসেজ পাঠায়।
"কাল বক্সা ফরেস্ট এর রাস্তায় দুপুর দুটোর দিকে "।সম্রাটের “ ঠিক আছে” মেসেজটা দেখে সুলেখা ঘুমাতে গেল।
দেরি করে ঘুমাতে যাওয়ায় সুলেখার ঘুম ভাঙতে একটু দেরী হয়ে গেল। চোখ খুলে দেখে, তন্ময় অবাক চোখে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আদুরে কন্ঠে সুলেখা বলে,কি হলো এভাবে কি দেখছ?
-তুমি কত সুন্দর তাই না? তোমাকে কেউ কেন ভালোবাসবেনা বলো ?
-ওঠো ,আমাদের দেরি হয়ে যাবে তো বের হতে ।
সুলেখা আজ তন্ময়ের প্রিয় বেগুনি রঙের শাড়ীটা পরলো।খুব সুন্দর ভাবে আছ সেজেছিল সুলেখা।
বক্সা জঙ্গলের রাস্তায় ঢুকতেই দুজনেরই চোখে পড়ল একটা বাইক ওদের গাড়িটাকে অনুসরণ করে পেছন পেছন আসছে । তন্ময় সুলেখা দুজনের মনের মধ্যে এক অজানা ঝড় বয়ে চলেছে। কিন্তু দুজনের মুখেই নাটকে হাসি। চোখের লাজুকতা অভিনয়।
হঠাৎ করেই তন্ময় গাড়ির ব্রেক কষলো।ঝাঁকুনি খেয়ে সুলেখা চোখ তুলে দেখো। সামনের বাইকটা ওদের গাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বাইক থেকে হেলমেট পরা একটা ছেলে নেমে,পিস্তল উঁচিয়ে দুজনকে হাতের ইশারায় নেমে আসতে বলছে ।
আশেপাশে কোন গাড়ি ও নেই তন্ময় সুলেখা দুজনেই গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলো। কিন্তুওদের কারো চোখেই সেই ভয় ছিল না। ছেলেটা পিস্তল তাক করলো সুলেখার দিকে। সুলেখা এবার ভয় পেয়ে গেল।
-কি চাই তোমাদের? সুলেখার কাঠ হয়ে যাওয়া গলা থেকে তন্ময় নামটা আস্তে করে বেরোলো।
তন্ময় আয়েশ করে সিগারেট ধরালো।
-কি সুলেখা ভয় পাচ্ছো? ভয় নেই আমিই টাকা দিয়েছি।এক গুলিতে কাজ হয়ে যাবে। তুমি কি ভাবলে একটা ছেলের জীবন নষ্ট করার কোনো ক্ষতিপূরণ তোমায় দিতে হবে না? আমার ভালোবাসা, আমার মনের কোন দাম তুমি কোন দিনই দিলে না।
স্বার্থপরের মত শুধু নিজের সুখের কথা ভেবেছো। ডিভোর্স দেওয়ার চেয়ে, খবরের কাগজে এটা বেরনো সন্মানের -" দুস্কৃতির গুলিতে মৃত সুলেখা মিত্র। স্বামীকে বাঁচাতে গিয়ে গুলি খেতে হল সতী সাবিত্রী সুলেখা দেবীকে।"
তন্ময়ের অট্টহাস্য জঙ্গলের প্রতিটা গাছে গাছে ধ্বনিত হতে লাগলো। নিমেষের মধ্যে একটা গুলি এসে বিঁধলো সুলেখার মাথায়।
হেলমেট পরা লোকটা কে ইশারা করলো তন্ময়। বাইকটা নিমেষেই ফাঁকা রাস্তা আর জঙ্গলের পথে মিলিয়ে গেল। তন্ময় সুলেখার রক্তাক্ত দেহটা পড়ে থাকতে দেখে আরেকটা সিগারেট ধরালো।
সিগারেটটা শেষ করেই তবেই থানায় ফোনটা করবে ভাবল।হঠাৎ করে ঝড়ের বেগে একটা বাইক এসে থামল তন্ময়ের কাছে।
-তন্ময় মিত্র তো।
-হ্যাঁ,
“হ্যাঁ” টুকু বেরোনোর অপেক্ষা ছিল শুধু। চোখের নিমেষে ধারালো ছুরির তীক্ষ্ণ আগাটা তন্ময়ের গলার নলি এপাশ-ওপাশ হয়ে গেল। সুলেখার পাশেই পড়ে গেল তন্ময়।যন্ত্রণায় কাতরানোর সময় টুকুও পেল না ।দুটো জীবন্ত মানুষ মুহূর্তে লাশে পরিণত হলো।
সম্রাট ব্যগ্র ভাবে ফোন টার জন্যই যেন অপেক্ষা করছিল। ফোনটা ধরে জিজ্ঞেস করল ...
-হয়েছে কাজটা?
-হ্যাঁ, দাদা। কিন্তু পাশেই একটা মহিলা গুলি খেয়ে পড়েছিল। আমি হোয়াটসঅ্যাপে আপনাকে ছবিটা পাঠিয়ে দিচ্ছি।
ছবিটা ডাউনলোড হতেই সম্রাট বসে পড়ল মেঝেতে। মুখ থেকে যন্ত্রণায় একটা শব্দটি উচ্চারিত হলো -"লেখা......."!
সুখ পাখিটা তন্ময় সুলেখার মাথার ওপর দিয়ে, শিস দিতে দিতে জঙ্গল পেরিয়ে সম্রাটের জানলার পাশ দিয়ে উড়ে চলে গেল।
“ সুখ পাখি ধরা যে সহজ কথা নয়।”
আপনি যদি আপনার লেখা আমাদের ওয়েবসাইটে পোস্ট করতে চান , তাহলে আমাদের ফেসবুক গ্রুপ "সাহিত্য মেলা "তে Join করুন ।
"সাহিত্য মেলা " - https://www.facebook.com/groups/sahityomela
0 মন্তব্যসমূহ
Thanks for your comments.