সারপ্রাইস - প্রলয় কুমার নাথ

সারপ্রাইস

প্রলয় কুমার নাথ


শাড়ির আঁচলে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে অফিস থেকে বাড়ি ফিরল অর্ণা। একে অসহ্য গরম, তারপর ফিরতি পথে অসম্ভব ভিড় বাসে লেডিস সিটেও বসার জায়গা পায়নি সে। বাথরুম থেকে বেরোতেই তার বিধবা শ্বাশুড়ি প্রভাদেবী এসে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন,
-- "আমার পুজোর জিনিসপত্রগুলো এনেছো তো বৌমা? কই কোথাও দেখছি না তো…"
অর্ণা জিভ কেটে বলল,
-- "এই যাহ, একেবারে ভুলে গিয়েছি মা…আসলে আজ ফিরতি পথে তাড়াহুড়ো করে ব্যাংকে গিয়ে মামের স্কুল ফিসটা দিতে হল যে, আজই যে এই মাসের লাস্ট ডেট ছিল ফিস জমা দেওয়া…তাই…"
ঠিক এই সময় মায়ের পিছু পিছু সেখানে হাজির হল অর্ণার অবিবাহিত ননদ সোহিনী, ওদিকে প্রভাদেবী মুখ ভেঙচে বলে উঠলেন,
-- "বাহ মামের স্কুলের মাইনের জন্য আমার পুজোর কথা তোমায় মনেই রইল না…কাল বাদে পরশু পুজো, এখন এই শরীরে আমি নিজে হাতে কি করে…"
অর্ণা প্রভাদেবীকে যথাসাধ্য বোঝাবার চেষ্টা করে বলল,
-- "ছি মা, এ কি বলছেন…আপনার পুজো তো পরশু দিন, তাই না? আমি কালই সব পুজোর জিনিস অফিস ফিরতি পথে কিনে এনে বাড়ি ঢুকবো…"
এই কথা শুনে প্রভাদেবী কতটা প্রসন্ন হলেন জানি না, হয়তো তিনি আরো কিছু বলতে চলেছিলেন, কিন্তু তার আগেই মায়ের পিছন থেকে সোহিনী ফুট কেটে বলল,
-- "থাক মা থাক…আসলে বুঝতে পারছ না, মেয়ের থেকে কি আর তুমি আমি বৌদির কাছে আপন হতে পারব কোনোদিন? চল এখান থেকে, আর ওর সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই…"
অর্ণা ওদের বাধা দিয়ে কি যেন বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই ওরা সেখান থেকে চলে গেল। অর্ণা শুনতে পেল যে যেতে যেতে প্রভাদেবী শাড়ির আঁচলে চোখ ঢেকে বলছেন,
-- "সাধে কি আর লোকে বলে বাড়ির বউ যদি বাইরে বেরিয়ে পয়সা রোজগার করে তাহলে ধরাকে সরা জ্ঞান করে…ও কেন মনে রাখবে আমার পুজোর কথা…এই যদি আমার সমু আজ অফিসে যেতে পারত, অর্থ উপার্জন করতে পারত, তাহলে কি কখনো মা কিছু চাইলে তা ভুলে যেতে পারত?"
কথাগুলো যেন সূঁচের মত বিধল অর্ণার কানে। সত্যিই কি মেয়েরা অর্থপার্জন করলে স্বার্থপর হয়ে ওঠে? কি জানি, তবে সে অন্তত তেমন নয়। আজ প্রায় বছর খানেক হল অর্ণার উপার্জনে এই সংসার চলছে। কখনো কি ভেবেছিল সে যে এমন দিনও তাকে দেখতে হবে? কত আশা নিয়ে, চোখে কত স্বপ্নের জলছবি এঁকে সে এই বাড়ির বউ হয়ে এসেছিল। স্বামী সৌমেন্দ্র পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, একটি সুবিশাল মাল্টি-ন্যাশনাল ফার্মে উচ্চ-পদে কর্মরত। নিতান্ত সময় কাটানোর জন্যই একটি প্রাইভেট ফার্মে রিসেপশনিস্টের চাকরিটা নিয়েছিল অর্ণা। বিয়ের পরপর এই বাড়ির সকলে তাকে কত স্নেহ করত, সবকিছু যেন স্বপ্নের মতই মনে হচ্ছিল তার। বিয়ের দুই বছরের মধ্যেই তাদের কোল আলো করে এল মাম। সেদিন থেকেই তার ওপরে কেমন যেন বিষিয়ে উঠতে থাকলেন প্রভাদেবী, তার যে ছিল নাতির মুখ দেখার খুব সাধ। তবে অর্ণার স্বপ্নকে দুঃস্বপ্নে পরিবর্তিত হতে লেগেছিল আরো বেশ কিছু বছর…যেদিন ঘটল সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটা! ফ্যাক্টরিতে শ্রমিকদের কাজ দেখানোর সময় অসাবধানতাবশত একটি উঁচু জায়গা থেকে পড়ে গিয়েছিল সৌমেন্দ্র। এতে তার জীবনহানি না হলেও সারা জীবনের জন্য অকেজো হয়ে গেল তার দুটি পা! তারপর আর কি, প্রাইভেট কোম্পানির চাকরি, তারা তো আর বসিয়ে বসিয়ে মাইনে দিয়ে যাবে না। কিছু দিন একটু মায়া দয়া দেখিয়েছিল তারা সৌমেন্দ্রকে, অবশেষে তার জায়গায় নতুন লোক দেখতে শুরু করল!
-- "মা, ওই পাখি দিয়ে গুলটি মারার গেমটা চালিয়ে দাও না…"
ছোট্ট মামের কচি গলার আওয়াজ পেয়ে বেডরুমে এগিয়ে গেল অর্ণা। বিছানার উপর বসে মাম প্রতিদিনের মতই তার ফোন নিয়ে ঘাটছে। আর প্রতিদিনের মতই পুব দিকের জানলা দিয়ে আকাশের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে হুইলচেয়ারের ওপর চুপ করে বসে আছে সৌমেন্দ্র। একটা সৌখিন হাসি খুশি মানুষের জীবনে কতটা বিপর্যয় ঘটলে তার মধ্যে এমন অমুল পরিবর্তন আসতে পারে তা সৌমেদ্রকে না দেখলে বোঝা যাবে না। এখন যেন কারোর সাথে কথা বলা তো দূর, পাঁচবার ডাকলে যেন তবে একবার সাড়া দেয় সে। নিজের দুই পায়ের মত নিজেকেও এই সংসারে নিতান্ত অকেজো একটি জঞ্জাল ছাড়া যেন কিছুই ভাবতে পারে না সে। অর্ণা হাসিমুখে মেয়ের কাছে এসে ফোনটা নিয়ে আনলক করে 'Angry Birds' গেমটা চালাতে যাবে এমন সময় দেখল আবার তার অফিসের বস রজত পাল তাকে বেশ কয়েকটা 'Whatsapp' মেসেজ পাঠিয়েছেন। সেই একই কথা বারবার…'কি হল? আর কত সময় নেবে? ভেবে দেখলে আমার প্রস্তাবটার ব্যাপারে?' হাসিমুখটা গম্ভীর হয়ে গেল অর্ণার, সে কোন রিপ্লাই না করে গেমটা চালিয়ে ফোনটা এগিয়ে দিল মামের কাছে। 
মুহূর্তের মধ্যে রজত পাল নামক এক বছর পঞ্চাশের কামুক ব্যক্তির মাথা ভর্তি টাক আর মসৃন করে কমানো ওই ধূর্ত মুখটার ছবি ভেসে উঠল তার চোখের সামনে। লোকটার স্ত্রী এবং দুই ছেলে বর্তমান, তবুও এখনো অল্প-বয়সী মেয়ে দেখলে নোলা সরসর করে। এই নিয়ে গোটা অফিসে তার বদনাম কিন্তু উচ্চপদ এবং কোম্পানির মালিকের নিকট আত্মীয় হওয়ার সুবাদে তিনি সেই সব কথা কখনো নিজের গায়েই মাখেন না। সৌমেন্দ্রর পঙ্গু হয়ে যাওয়ার খবর পাওয়ার পর থেকেই তার কুদৃষ্টি পড়েছে অর্ণার ওপর। বারে বারে নানা দিন নানা অছিলায় নিজের কেবিনে ডেকে সেই একই প্রস্তাব তিনি তাকে দিয়ে চলেছেন…অর্ণা যেন তার পঙ্গু স্বামীকে ডিভোর্স করে তার সাথে তার বাংলোয় এসে ওঠে! তার ওই পঙ্গু স্বামী কি দিতে পারবে তাকে? আর্থিক স্বচ্ছলতার কথা না হয় বাদই দিলাম…শারীরিক সুখ, সেই চাহিদাও কি এই অবস্থায় ঠিক মত মেটাতে পারছে সে? তাই অর্ণা যেন তার কাছে এসে থাকে, তার মত সুন্দরীকে সোনায় মুড়িয়ে একেবারে রাজরানী করে রাখবেন রজত…ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রথম প্রথম এইসব শুনে হকচকিয়ে উঠত অর্ণা, কিন্তু পরে যেন এইসব গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। তবে সে এইটুকু বুঝেছে যে এই মানুষটাকে চটালে তাকে এই অফিস থেকে পাততাড়ি গোটাতে হবে, আর এমন হলে তার সংসারের হাড়ি চড়বে কি ভাবে? তাই সে রজতবাবুর সকল বেয়াদবি মুখ বুজে সহ্য করছে, ভাবার জন্য সময় চেয়ে নিচ্ছে…কিন্তু এইভাবে আর কতদিন চালাতে পারবে সে? 
এত ক্লান্ত হয়ে ফিরেও যেন রাতে দুইচোখের পাতা এক করতে পারছে না অর্ণা। কাল অফিসে গেলে আবার ওই রজত পালের কুপ্রস্তাব সহ্য করতে হবে, বাড়ি ফিরলে মা বা ননদের সকল ফর্মাস পূরণ করলেও কোন না কোন ভাবে ওরা তাকে অপদস্থ করবেই…এই যেন তার নিত্যদিনের রুটিন। মাঝে মাঝে নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছা করে অর্ণার। কিন্তু পারে না শুধু তার কথা ভেবে যে এখন বিছানায় তার আর সৌমেন্দ্রর মাঝে শুয়ে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমোচ্ছে…তার ছোট্ট সোনা, মাম…তার নয়নের মণি…তাকে বড় করার জন্য, মানুষের মত মানুষ করার জন্য হাজার লাঞ্ছনাও সহ্য করে নেবে অর্ণা! অদূরে দেওয়াল ঘড়িতে ঢং করে রাত বারোটা বেজে উঠল। ঠিক এমন সময় অর্ণাকে অবাক করে হঠাৎ সৌমেদ্র বলে উঠল,
-- "অনু…আজ কত তারিখ বলো তো?"
এই সময় এমন বিচিত্র প্রশ্ন শুনে বিস্মিত স্বরে অর্ণা বলল,
-- "কেন ওই এগারো…না, এখন তো বারোটা বেজে গেল…তাহলে আজ ওই বারোই জুন…হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?"
-- "সেটা নিজেকেই একবার জিজ্ঞাসা করে দেখ, উত্তর পাবে!"
হ্যাঁ, একটু ভেবেই উত্তর পেল অর্ণা। আসলে সবসময় পরিবারের অন্যদের সম্বন্ধে ভেবে ভেবে কখন যেন নিজেকে নিয়ে ভাবতে ভুলেই গিয়েছে সে। তার মনেই ছিল না যে আজ হল তার জন্মদিন। এবার অর্ণাকে আরো অবাক করে হঠাৎ সৌমেন্দ্র আঁকড়ে ধরল অর্ণার ডান হাতটা, তারপর মৃদু স্বরে বলল,
-- "কি ভাবছো হ্যাঁ? তোমার স্বামী হাটতে পারে না, কোন উপার্জন তার নেই, তাই বলে কি সে তার স্ত্রীকে জন্মদিনে কোন সারপ্রাইস গিফ্টও দিতে পারে না?"
-- "ম…মানে? তুমি আমার জন্য স…সারপ্রাই গিফ্ট কিনেছো?", অপার অবিশ্বাস অর্ণার গলায়।
-- "ওঠো…ঘরের আলো জ্বালাও…আলমারিটা খুলে নিচের দিক থেকে ডান দিকের দুই নম্বর তাকে দেখো!"
অর্ণা তখনই উঠে ঘরের আলো জ্বালিয়ে আলমারি খুলল। নির্দিষ্ট তাকে দেখল উপহার দেওয়ার রঙিন মোড়কে বাধা রয়েছে কোন পাতলা বস্তু…কি এটা? এতক্ষন অর্ণা ভাবছিল যে হয়তো কোন সস্তার শাড়ি বা অন্য কিছু সৌমেন্দ্র তার জন্য কিনে রেখেছে…এখন তো মনে হচ্ছে এটা তাও নয়! হয়তো কোন বার্থডে উইশ লেখা কার্ড এটা…তবুও অর্ণা হাসিমুখে ঝলমলে মোড়কটা খুলতে শুরু করল।

পরদিন নির্দিষ্ট সময়ে অফিসে পৌঁছে সোজা রজত পালের চেম্বারে ঢুকল অর্ণা। রজতবাবু অপর এক ম্যানেজারের সাথে সেই সময় কথাবার্তা বলতে ব্যস্ত ছিলেন। অর্ণাকে নিজের ইচ্ছায় তার কেবিনে আসতে দেখে তিনি মুখে এমন অভিব্যক্তি করলেন যেন দেখে মনে হল 'এ তো মেঘ না চাইতেই জল!' তিনি তখনই অপর ব্যক্তিটির কাছ থেকে সাময়িক বিরতি চেয়ে নিলেন। তিনি চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেলে হাসিমুখে অর্ণা এগিয়ে গিয়ে বসল রজত বাবুর ঠিক সম্মুখে। তারপর রজতের চোখে চোখ রেখে সে বলল,
-- "আমি অনেক ভেবে দেখলাম আপনার প্রস্তাবটার সম্বন্ধে, স্যার…হ্যাঁ, সত্যি আপনি একেবারে হক কথা বলেছেন…ওই পরিবারে ওই পঙ্গু স্বামীর কাছে থেকে আমি জীবনে কোন সুখই পাবো না, উপরন্তু আমাকেই ওদের চোদ্দ গুষ্টির পেটে ভাত যোগাতে হবে!…তবে আমি একটু জানতে চাই আপনি আমার জন্য ঠিক কি কি করতে পারবেন?"
অর্ণার গলায় এই সুর শুনে গেল রজতবাবুর চিত্ত গদগদ হয়ে উঠল। তিনি উত্তেজিত হয়ে বললেন,
-- "আরে তুমি বলো না কি করতে হবে? সোনা দানা যা চাও সব! তোমার মেয়েরও দায়িত্ব নেব আমি। এই শহরে আমার চারটে বাংলো আছে তার মধ্যে একটা পুরো তোমার নামে করে দেব…গাড়িও আছে তিনটে, তার মধ্যেও একটা…"
তার কথা শেষ না হতেই অর্ণা বলল,
-- "দাঁড়ান মিস্টার পাল, আমি কি চাই জানেন? ঠিক যেমন আমি সৌমেন্দ্রকে ডিভোর্স করে ওই পরিবারের সাথে সমস্ত সম্পর্ক শেষ করে আপনার কাছে আসব, আমাকে পেতে গেলে আপনাকেও আপনার স্ত্রীকে ডিভোর্স করে পরিবারের সাথে সকল সম্পর্ক শেষ করে আমার কাছে আসতে হবে…বলুন আপনি রাজি?"
মুহূর্তের মধ্যেই পাংশুবর্ণ ধারণ করল রজতবাবুর মুখ।
-- "সে কি! এ কি বলছ তুমি…ওর সাথে সম্পর্ক শেষ করব কি করে আমি? আইনত সে আমার স্ত্রী, আমার দুই সন্তানের মা!"
-- "তাহলে আমি আপনার কে হতে চলেছে, মিস্টার পাল?", তারস্বরে চিৎকার করে উঠল অর্ণা, "রক্ষিতা?"
অর্ণার কন্ঠস্বর যেন বন্ধ কেবিনের বাইরেও এসে পৌঁছল বাকি সকল কর্মচারীদের কানে। রাগে লাল হয়ে উঠল রজতবাবুর মুখ। তিনি লাজলজ্জা ভুলে উদ্ধত ভঙ্গিতে বলে উঠলেন,
-- "তোমার মত পঙ্গু স্বামীর সুন্দরী অভাগিনী স্ত্রী আর হতেও বা কি পারে বলো? কোন বড়লোকের রক্ষিতা ছাড়া?"
খিলখিল করে হেসে উঠল অর্ণা। বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে সে বলতে শুরু করল,
-- "কাল রাতে আমার জন্মদিন উপলক্ষে আমার ওই পঙ্গু স্বামী আমাকে একটি সারপ্রাইস গিফ্ট দিয়েছে…কোন দামী শাড়ি বা গহনার থেকে আমার কাছে যার মহত্ব আরো অনেক বেশি…এই দেখুন সেটা কি…"
এই বলে অর্ণা তার হাতে ধরা একটি চ্যানেল ফাইল এগিয়ে দিল রজত পালের কাছে। বিস্মিত মুখে রজত বাবু ফাইলটা উল্টে পাল্টে দেখতে থাকলেন, ওদিকে অর্ণা বলেই চলল,
-- "হ্যাঁ, এই কথা সত্য যে আজ এক বছর আমার স্বামী পঙ্গু। কিন্তু আমি তার চিকিৎসার কোন খামতি রাখিনি। নিজের স্বল্প উপার্জনের অর্ধেকটাই খরচা করেছি ওর চিকিৎসার ওপর। ডাক্তার, ও নিজে এবং ওর বাড়ির লোকেরা হাল ছেড়ে দিলেও আমি ছাড়িনি। গত সপ্তাহে ওর কয়েকটি টেস্ট করানো হয়েছিল, সেই টেস্টের রিপোর্ট কাল পৌঁছেছে ওর কাছে। খুব আশ্চর্যজনক ভাবে হঠাৎ করেই ওর খোঁড়া দুই পায়ের অবস্থার দ্রুত উন্নতি হতে শুরু করেছে। সেই রিপোর্ট ও মেল করেছিল অর্থোপেডিক ডাক্তার বাবুকে যার কাছে ও চিকিৎসারত। তিনিও যারপরনাই বিস্মিত হয়েছেন এই রিপোর্ট দেখে, বলেছেন এটা ভগবানের আশীর্বাদ ছাড়া আর কিছু নয়।এখন তিনি নিশ্চিত আর দুই তিন মাসের মধ্যেই সৌমেন্দ্র আবার নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হবে।"
-- "কি বলছ তুমি!", রজতবাবু গলায় বিস্ময়ের সুর।
-- "শুধু তাই নয়…এই কথা সৌমেন্দ্র ওর পুরোনো অফিসেও জানিয়েছে। ওখানে সে বরাবরই খুব সুনামের সাথে কাজ করে এসেছে, তাই তারাও ওর কথা ভেবে ওকে লিখিত ভাবে জানিয়েছে যে নির্দিষ্ট সময়ে সুস্থ হয়ে উঠলে ও আবার কাজে যোগদান করতে পারবে। ওর চাকরি বজাই থাকবে!"
নতমুখে ফাইলের পাতা উল্টে চলেছিলেন রজতবাবু। কিছুক্ষন পর আবার বলতে শুরু করল অর্ণা,
-- "এবার শেষ সুখবরটাও দিয়ে ফেলি আপনাকে। কয়েকমাস আগে একটি টিভি চ্যানেল তার লাইভ শো-এর এঙ্কর চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল…আমি গিয়েছিলাম অডিশনে। তবে সেখানকার বিপুল সংখ্যক চাকরিপ্রার্থী দেখে এক কথায় ছেড়েই দিয়েছিলাম ওখানে চাকরি পাওয়ার কোন আশা…কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস দেখুন, আমার ভাগ্যেই জুটে গেল চাকরিটা! সেখানকার এপইন্টমেন্ট লেটারটাও কালকেই এসে পৌঁছেছে আমার বাড়িতে। তাই নিজের ডাক্তারি রিপোর্টের সাথে এটাকেও সৌমেন্দ্র রেখেছিল আমার সারপ্রাইসের মোড়কের ভেতর। আর একমাস পরই ওখানে আমার জইনিং। তাই বুঝতেই পারছেন আমার মত পঙ্গু স্বামীর সুন্দরী অভাগী স্ত্রী কোন বড়লোকের রক্ষিতা ছাড়াও আর কি হতে পারে!"
এই বলে এক ঝটকায় ফাইলটা রজতবাবুর হাত থেকে কেড়ে নিল অর্ণা। তারপর ফাইলের শেষ পাতাটা বার করে ছুঁড়ে মারল তার মুখের ওপর। শান্ত নিরুদ্বিগ্ন কন্ঠস্বরে অর্ণা বলে উঠল,
-- "এটা কিন্তু ছিল না ওই মোড়কের ভেতর। এটা আমার নিজের হাতে লেখা, যা দিয়ে আমি আপনাকে সারপ্রাইস দিতে চাই মিস্টার পাল…এটা আমার রেসিগনেশন লেটার!"
রজতবাবু বিহ্বল হয়ে চেয়ে রইলেন অর্ণার দিকে।

বাড়ির ডোরবেল বাজাতে প্রভাদেবী এসে দরজা খুললেন। ক্লান্ত বিধ্বস্ত অর্ণা বাড়ির ভেতরে ঢুকতে গিয়েও হঠাৎ প্রভাদেবীকে দেখে জিভ কেটে বলে উঠল,
-- "এই যাহ…আজকেও ভুলে গেলাম আপনার পুজোর জিনিসগুলো আনতে, মা!…আচ্ছা, আমি এখুনি সামনের বাজারটা থেকে…"
অর্ণার কথা শেষ না হতেই প্রভাদেবী হাসিমুখে তার হাত ধরে তাকে ঘরে টেনে এনে বললেন,
-- "তার আর কোন দরকার নেই, মা! আমাদের পরিবারের মা লক্ষী যে আমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে…তাকে পুজো করতে ফুল, ফল, মিষ্টি লাগে না…লাগে শুধু একটু মেয়ের প্রতি মায়ের আদর আর ভালোবাসা…আমার এমনই পোড়া কপাল, যে তা থেকে আমি এতদিন তাকে বঞ্চিত করে এসেছি!"
-- "এ কি বলছেন মা!", অর্ণার কণ্ঠে বিস্ময়।
সেই সময় সোহিনী পাশ থেকে এসে বলল,
-- "মা, ঠিকই বলছে বৌদি। দাদার এক্সিডেন্টের পর তুমিই এই সংসারের কান্ডারী হয়েছ, আমাদের এতগুলো পেটে অন্ন জুগিয়ে এসেছ। আর আমরা কিনা তোমাকেই কথায় কথায় অপমান করেছি, ছোট করেছি। দাদার সাথে আমাদের রক্তের সম্পর্ক থাকলেও আমরা ওর ব্যাপারে হাল ছেড়েই দিয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আশা ছাড়োনি। নিজের উপার্জনের অর্ধেকেরও বেশি অংশ দিয়ে তার চিকিৎসা করিয়ে গিয়েছো। তাই হয়তো তোমার এই অসাধারণ জেদ, সহনশীলতা এবং একাগ্রতার ফলেই ভগবান খুশি হয়ে দাদাকে সুস্থ করতে চলেছেন। তাই আমাদের কাছে তোমার স্থান ভগবানের কাছেই বৌদি…পারলে আমাদের ক্ষমা করো।"
অর্ণা "ধুর পাগলী!" বলে সোহিনীকে বুকে টেনে নিল। প্রভাদেবী প্রসন্ন চিত্তে শাড়ির আঁচলে নিজের চোখ মুছলেন। অর্ণা দেখল যে বেডরুম থেকে মামও ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। হুইলচেয়ারের হাতল ঘুরিয়ে বেরিয়ে এল সৌমেন্দ্রও। নিজের সহধর্মিণীর প্রতি অগাধ ভরসা, বিশ্বাস এবং ভালোবাসা যেন ঝলকে উঠছে তার দুই জল ভরা চোখে।


আপনি যদি আপনার লেখা আমাদের ওয়েবসাইটে পোস্ট করতে চান , তাহলে আমাদের ফেসবুক গ্রুপ  "সাহিত্য মেলা "তে  Join করুন । 

"সাহিত্য মেলা " - https://www.facebook.com/groups/sahityomela


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

close