মরুগ্ৰামে একরাত - অনিন্দিতা


মরুগ্ৰামে একরাত

অনিন্দিতা 

একটা অ্যাডফিল্মের শ্যুটে রাজস্থান এসেছি| আমি অয়ন্তিকা, অয়ন্তিকা বসু| এই কোম্পানিটা নতুন| সাধারণত কোম্পানির গুডউইল না দেখে আমি কাজ করতে রাজি হই না কিন্তু ' সোনার কেল্লা '-তে শ্যুটিং করার উত্তেজনাই আমাকে এখানে টেনে এনেছে | শ্যুটিং হবে জয়সলমীর দূর্গে| ছোটবেলায় ' সোনার কেল্লা ' দেখার পর থেকেই ফেলুদা সিরিজের প্রতি এক আলাদা আকর্ষণ তৈরি হয়| সত্যজিতের জাদু না সৌমিত্রের ক্যারিশমা না সন্তোষ দত্তের নিখুঁত কমিক টাইমিং সেটা ভালো করে বুঝতে পারি নি বটে কিন্তু মরু শহরের রোমাঞ্চকর পরিবেশ যখনই আমাকে হাতছানি দিয়েছে দৌড়ে এসেছি সে ডাকে সাড়া দিতে|

আমাদের অ্যাডফিল্মের পরিচালক দেখলাম বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অনেক পড়াশুনা করেছেন| সঞ্জীব বর্মন অ্যাডমেকার না হয়ে প্রফেসর হলেও খুব একটা মন্দ হত না | শুটিংয়ের ব্যতিরেকে ভদ্রলোক বলছিলেন " রাওয়াল জয়শল " নাকি দ্বাদশ কশতে এই দুর্গ নির্মাণ করেন| পৃথিবীর যে কয়েকটা মরুভূমি দুর্গ নির্মিত হয়েছে, তার মধ্যে এটি অন্যতম| শ্যুটিংয়ের ফাঁকে দুর্গটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম| ভীষণ সুন্দর| কত মন্দির, কত স্থাপত্যের নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে ইতস্ততঃ| মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিলাম, হঠাৎ একজন ক্রু মেম্বার এসে বলল সঞ্জীব স্যার আমায় ডাকছেন|
মরুভূমির বুকে পোশাক উড়িয়ে বেশ কয়েকটা স্টিল নেওয়ার পর পরিচালক সঞ্জীবের লুক পছন্দ হল | তারপর টানা শ্যুট! একদল দস্যু হীরের ঝলক দেখে আমার হাত থেকে কোটি টাকা মূল্যের ব্যাঙ্গেল ছিনিয়ে নিতে চায়, কিন্তু আমার অন্য হাতে ধরা সুস্বাদু শরবতের বোতলে চুমুক দিয়ে মোহিত হয়ে যায়| একে একে সব দস্যু শরবতে চুমুক দিতে থাকে! বোতল শেষ হতেই দস্যু সর্দার আমার পায়ের নীচে বসে পড়ে.... সর্দারের দেখাদেখি বাকিরাও| ওরা কাতরস্বরে শরবতের জন্য আবেদন করতে থাকে| আমিও ম্যাজিশিয়ানের মত হাত বাড়িয়ে এক ক্রেট শরবতের বোতল এনে ওদের মধ্যে ভাগ করে দি| ওরা আনন্দে সবাই আমায় ঘিরে নাচতে থাকে| স্ক্রিনে ভেসে ওঠে... " অরেঞ্জলাইটের স্বাদ/ দস্যুরাও কুপোকাত| "


শ্যুটিং শেষ| কাল ফেরার পালা| পরশু থেকেই আবার শ্যুটিংয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হবে| কারুরই আর শোয়ার ইচ্ছে নেই| টেন্টে থাকার ব্যবস্থা| সঞ্জীব সহ সবাই গোল হয়ে বসে গল্প করছে | সবার সামনে রাজস্থানী থালি, হাতের কাজের চেয়ে মুখ বেশি চলছে| রাজস্থানী সুন্দরীরা গোল হয়ে ঘুমর নেচে আগত অতিথিদের মনোরঞ্জনের চেষ্টা করছে| আমার বেশ ক্লান্ত লাগছে, এবার ঘুমোতে হবে| কাল সকালেই ফ্লাইট| চোখদুটো জুড়ে আসছে... সঞ্জীবকে ইশারায় জানালাম ক্লান্ত লাগছে | তারপর ধীর পদক্ষেপে কাউকে বিরক্ত না করে নিজের টেন্টের দিকে চলে গেলাম | 
গভীর রাতে কিসের একটা শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল| টেন্ট থেকে বেরিয়ে দেখি জ্যোৎস্নালোকিত বালু প্রান্তর সারা গায়ে পূর্ণিমা চাঁদের রূপোলী আলো মেখে ঝলমল করছে| একটা দুধসাদা ঘোড়া তেজি কেশর দুলিয়ে, পা ঠুকে আমায় ডাকছে... আমার কি হল জানি না| মোহাবিষ্টের মত এগিয়ে গিয়ে আমি ঘোড়ার লাগাম চেপে ধরলাম| সম্মুখে ধু ধু প্রান্তর... যতদূর দেখা যায় শুধু বালি আর বালি| বহুদিন আগে একটা সিনেমায় অভিনয় করার সূত্রে আমায় ঘোড়ায় চড়া শিখতে হয়েছিল| আমি পাদানিতে পা দিয়ে শক্ত হাতে লাগাম চেপে ধরে ঘোড়ার পিঠে উঠে বসলাম| মৃদুমন্দ চালে ঘোড়া চলতে লাগল | আকাশে পূর্ণচন্দ্র, তারারা মিটমিট করে জ্বলছে, নিভছে, সম্মুখে দিগন্ত বিস্তৃত ধূ ধূ বালু রাশি| আমার মনে হল এ দেশ রূপকথার| আমি অভিনেত্রী অয়ন্তিকা নই, আমি এক রূপকথার রাজকন্যা, আর এই সাদা তেজি ঘোড়াটা আমার পক্ষীরাজ | পূর্ণিমা রাত্রির রূপোলি আলোয় এই নিস্তব্ধ মরুভূমির বুকে নিশ্চয়ই কোন রাজপুত্র আমার জন্য অপেক্ষারত.... কিন্তু এবার যে ভীষণ দেরি হচ্ছে যাচ্ছে! আমায় সকালে ফ্লাইট ধরতে হবে| আমি লাগাম কষে ধরতেই পক্ষীরাজ দৌড়তে শুরু করল| কোথায় যাচ্ছে? কোথায় যাচ্ছে ও? রাজপুত্রের কাছে বুঝি!


পলক ফেলতে পেরিয়ে যাচ্ছে.... ঊষর মরুভূমি... ধূসর প্রান্তর| কোথায় যাচ্ছি আমি? এ পথের শেষ কোথায়? আমি লাগাম ঢিলে করার চেষ্টা করলাম কিন্তু তুরঙ্গম তখন গতির মজা পেয়ে গেছে, আমার কি সাধ্য ওকে আটকাই!
বিশাল পাথরের ফটক পার হয়ে এক সহর্ষ হ্রেষা ধ্বনি তুলে ঘোড়াটা স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে পড়ল| আমি চতুর্দিকে তাকিয়ে দেখলাম ঘোড়াটা  একটা গ্রামের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে| বর্ধিষ্ণু গ্ৰাম| আমি সাবধানে ঘোড়া থেকে নেমে এলাম | সামনেই সরপঞ্চ অভ্যর্থনার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন| বললেন রোহিল বেটা আপনাকে আমাদের গ্রামে নিয়ে এসেছে| আজ রাতের জন্য আপনি আমার অতিথি| কোন চিন্তা করবেন না অতিথি সৎকারে আমরা যথেষ্ট পারদর্শী| আসুন, আমার সঙ্গে আসুন‌| 
আমি চারপাশ তাকিয়ে বর্ধিষ্ণু গ্ৰামের দৃশ্য দেখতে দেখতে বললাম, এ যে অপূর্ব সুন্দর| মনে হচ্ছে কোন শিল্পী যেন ক্যানভাসের উপর সযত্নে তুলি বুলিয়ে গ্ৰামটাকে এঁকেছেন| আপনাদের গ্রামের নাম কি? 
সরপঞ্চ হাসলেন, সাজানো দাঁত ঝকঝক করে উঠল| আগে তো আমাদের গ্রামটা ঘুরে দেখুন| নাম নাহয় পরেই জানবেন | জাতে আমরা পালিওয়াল ব্রাক্ষ্মণ| এর আগে আমরা যোধপুরের পালি এলাকায় বসবাস করতাম| এখন এই চুরাশিটা গ্রাম জুড়ে আমাদের বসতি|


একটু চমকে উঠলাম| যোধপুরের পালি সম্প্রদায়ের ব্রাক্ষ্মণের কথা কোথায় যেন পড়েছি! দরকারের সময় স্মৃতিও বিট্রে করে! অপূর্ব সুন্দর জনপদ, দেখলে মুগ্ধ হতে হয়| মরুগ্রামের বুক জুড়ে রয়েছে বেশ কয়েকটি সুস্বাদু জলের কুয়ো| বেশ গভীর... বুঝলাম এই কুয়োগুলো থেকেই গ্রামের মানুষজনের পানীয় জলের চাহিদা মেটে| ধাপ কেটে কেটে গভীর থেকে গভীরে নেমে গেছে কুয়ো ! সরপঞ্চ জানালেন, এখানকার গ্ৰামে এরকমই সব কুয়ো দেখতে পাবেন, এ কুয়োর নাম ধাপ-কুয়ো| গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ক্ষীণধারা এক নদী... সেই জলের রঙ গেরুয়া| সরপঞ্চকে নাম জিজ্ঞেস করতে বললেন, এ নদীর নাম কাঁকনি... বেশ অদ্ভুত নাম তো! মেয়েদের হাতের কাঁকন নাকি? মনে মনে দুবার উচ্চারণ করলাম কাঁকনি... কাঁকনি ! 


গ্রামের বাড়ি থেকে মেয়ে-বউরা উঁকি মেরে অবাক চোখে আমাকে দেখছে | ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কেমন ভয় বিহ্বল দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে! বুঝলাম আমার বিজাতীয় পোশাকটাই ওদের অস্বস্তির কারণ| একটা ছোট্ট বাচ্চা ছেলেকে ইশারায় কাছে ডাকলাম| সে মুখে আঙুল পুড়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আমার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করতে লাগল| কিন্তু কিছুতেই কাছে এল না| সরপঞ্চ পাগড়ি জড়ানো মাথা নেড়ে হাসিমুখে আমার ছেলেমানুষী দেখছিলেন| আমি ওনার চোখের দিকে তাকাতেই উনি চোখ নামিয়ে নিলেন| একঝলক দেখে মনে হল চোখ দুটো যেন মরা মাছের মত ঘোলাটে! শরীর জুড়ে একটা তীব্র অস্বস্তি, হাত-পায়ে জোর পাচ্ছি না! সরপঞ্চ বললেন আমার সঙ্গে আসুন| আমি মোহাবিষ্টের মত এগিয়ে চললাম| যেন নিজের ইন্দ্রিয়ের উপর সব নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলেছি|
হঠাৎ একটা বউয়ের চোখের দিকে চোখ পড়ল| সে তড়িৎগতিতে চোখ নামিয়ে নিল! কিন্তু আমি যা দেখার তা দেখে নিয়েছি, সেই একই রকম মরা মাছের দৃষ্টি... জীবিত মানুষের চোখের দৃষ্টি এমন কেন? আমার কেমন যেন ভয় ভয় করতে লাগল| পূর্ণিমা রাত্রে এ আমি কোথায় এলাম ?
সরপঞ্চ বললেন আসুন, এই আমাদের গ্রামের মূল মন্দির| আমি জুতো খুলে মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করলাম| সরপঞ্চ হাসলেন, আমরা জাতে বৈষ্ণব| আমাদের প্রধান আরাধ্য দেবতা হলেন শ্রী বিষ্ণু| মাতা দুর্গাও এখানে দেবীরূপে পূজিত হন| বিঘ্নশ্বর গণপতি আমাদের রক্ষা করেন তাই প্রতিটি বাড়ির সম্মুখের দরজায় তাঁর আসন পাতা রয়েছে| চলুন... আমি মন্দিরে উপবিষ্ট ঈশ্বরকে হাতজোড় করে প্রণাম জানিয়ে সরপঞ্চের পিছু পিছু রওনা দিলাম|  খানিক এগিয়ে তিনি আমাকে একটা ষাঁড়ের মূর্তি দেখিয়ে বললেন ষাঁড় আমাদের পূজ্য| আমরা এক ঘোড়সওয়ার লৌকিক দেবতারও আরাধনা করে থাকি! আমি চুপচাপ ওনার কথা শুনছিলাম| আমি জানি রাজস্থানের বিভিন্ন গ্রামে লোকাচার অনুসারে নানান লৌকিক দেবদেবী পূজিত হয়ে থাকেন| 


চলুন এবার কিছু আহার করা যাক| গ্ৰামে এসেছেন যখন তখন আমাদের অন্ততঃ খানিক অতিথি সৎকারের সু্যোগ দিন| আমার মনে হল সত্যিই বেশ খিদে পেয়েছে! পাথরের বাঁধানো রাস্তা পেরিয়ে সরপঞ্চের বাড়ির সামনে এলাম | সদর দরজায় গণপতি বিরাজমান| স্নিগ্ধ পরিবেশ, ঘাঘরা, চুনরি, হাতভর্তি রকমারি কাঁচের চুড়ি পরিহিত এক সুন্দরী বধূ থালা সাজিয়ে আমার জন্য রাজস্থানী খানা নিয়ে এল| আমি দেখলাম সরপঞ্চ চোখ নীচু করে গ্ৰামের গল্প বলে যাচ্ছেন| কিছুতেই আমার দিকে চোখ তুলে তাকাচ্ছেন না|
কৌতুহল বাগ মানছিল না| অতিথির সঙ্গে এ কেমন আচরণ? জিজ্ঞেস করলাম আপনারা এই গ্রামে কতদিন ধরে আছেন? 
সরপঞ্চ কেমন এক অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসলেন... আছি না থাকতাম| ১৮২৫ সালের পর থেকেই এ গ্রাম জনশূন্য| জয়শলমীর স্টেটের দেওয়ানের নজর পড়েছিল আমার কন্যার উপর| জয়শলমীরের তৎকালীন সামন্ত শাসক ছিলেন নারী লোলুপ ও ভয়ঙ্কর রকমের অত্যাচারী| প্রতিদিন নারীসঙ্গের প্রয়োজন মেটাতে সামন্ত শাসকের সেনারা স্থানীয় গ্রামের প্রজাদের কাছ থেকে সুন্দরী মেয়েদের ছিনিয়ে হাভেলিতে নিয়ে যেত| আমার সুন্দরী কন্যার উপরও সেই সামন্ত শাসকের নজর পড়ে| তিনি ফতোয়া জারি করেন, হয় দ্বিগুণ খাজনা দাও... নয় সরপঞ্চের সুন্দরী কন্যাকে স্বেচ্ছায় আমার হাতে তুলে দাও| আর যদি এই প্রস্তাবে তোমরা রাজি না হও সেক্ষেত্রে দ্বিগুণ খাজনা তো দিতেই হবে... আর সামন্ত শাসকের সেনাবাহিনী এসে কুমারী কন্যাকে হাভেলীতে নিয়ে যাবে| আমাদের গ্রামের সবাই সামন্ত শাসকের কাছে কেঁদে পড়ে! উনি গ্ৰামবাসীকে একদিনের সময় দেন| 
আমি চিত্রার্পিতের মত শুনছিলাম | সরপঞ্চের দিকে তাকিয়ে বললেন তারপর... 
সরপঞ্চ বললেন, সমবেত আলোচনার পর গ্রামবাসীদের কেউই আমার ফুলের মত নিষ্পাপ কিশোরী কন্যাকে সামন্ত শাসকের মত অত্যাচারী লম্পটের হাতে তুলে দিতে রাজি হল না| নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর ওনার সেনা কন্যা নিয়ে যেতে চাইলে আমরা জানিয়ে দিই যে আমাদের নিয়মানুসারে বিকেলে কন্যা বিদায় সম্ভব নয়| কাল সকালেই আমরা সবাই মিলে কন্যাকে হাভেলিতে পৌঁছে দেব| দেবী দুর্গার পুজো করার পর গ্রামের বাসিন্দাগণ নিজেদের মেয়েকে রক্ষা করার শপথ নিয়ে মন্দির থেকে বেরিয়ে আসেন| আর সেরাত্রেই উত্তপ্ত বালুকাবক্ষে শুরু হল মরুঝড়| ঢেকে যায় গ্ৰাম কে গ্ৰাম| উত্তপ্ত বালির নিচে আমাদের সমাধি রচিত হয় কিন্তু নারীর ইজ্জত ভুলুন্ঠিত হয় নি| দেবীর বরদান সফল হয়| পরের দিন সকাল হতেই সামন্ত শাসকের সেনাবাহিনী গ্রাম ঘিরে ফেলে কিন্তু গ্ৰামে আর কোন মানুষজন ছিল না| কেবল স্তব্ধ, জনশূন্য রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, মন্দির, স্থাপত্য ওদের অভ্যর্থনায় উপস্থিত ছিল| যেন জানান দিচ্ছিল এ গ্রামগুলোতে কোন একসময় মানুষ বাস করত! 


আমি স্তব্ধবাক! কি ভয়ঙ্কর কাহিনী যেন বাস্তব বলে ভ্রম হয়| গল্প শেষ করে সরপঞ্চ পেতলের ঘটি থেকে ঢকঢক করে জল খেলেন| তারপর মরা মাছের মত চোখ তুলে সোজাসুজি তাকাতেই আমার শিরদাঁড়া বেয়ে যেন এক হিমেল স্রোত নেমে গেল| আমি চমকে উঠে বললাম এ গ্রামের নাম কি কুলধারা! 
বাতাসে কারা যেন অট্টহাসি হাসতে লাগল| হাসির দমকে সরপঞ্চের দেহটা টুকরো টুকরো হয়ে বাতাসে মিলিয়ে গেল| চোখের সামনে দুমড়ে, মুচড়ে যাচ্ছে ঘর, উঠোন, স্থাপত্য, শিল্পকলার নির্দশন| আমি অচেতন হতে হতে দেখলাম রোমিল আমাকে পিঠে তুলে নিয়ে হাওয়ার বেগে উড়ে চলেছে| 
জেগে উঠতে দেখি আমার চারপাশে শ্যুটিং দলের লোকজনের ভীড়| আমাকে চোখ মেলতে দেখেই সঞ্জীবের প্রশ্নবাণ ধেয়ে এল... কি হয়েছিল তোমার? অত রাতে টেন্ট থেকে বেরিয়ে একা একা অতদূরে গেছিলে কেন? অজ্ঞান হলে কি করে? কোন ভয়ঙ্কর জন্তু টন্তু দেখেছিলে নাকি? 
একজন বলল জন্তু নয় বোধহয়! গায়ে তো কোন আচড়ের দাগ দেখছি না| 
সঞ্জীব বলল, ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে তোমার টেন্ট ওপেন দেখে আমাদের ক্রু মেম্বার পঞ্চু ভয়ে ভয়ে টেন্টে উঁকি দেয়| সেখানে তোমায় দেখতে না পেয়ে ও ভীষণ ভয় পেয়ে যায়| খুঁজতে খুঁজতে খানিকদূর গিয়ে দেখে তুমি মুখ গুঁজে বালিতে পড়ে আছ| ও সঙ্গে সঙ্গে আমাদের খবর দেয়... আমরা গিয়ে তোমাকে টেন্টে নিয়ে আসি| উঃ আজ তো তুমি আমাদের রীতিমত ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে! কি মনে হচ্ছে ফিরতে পারবে? তোমার কি ঘুমের মধ্যে হাঁটার অভ্যেস আছে?
আমি ফ্যালফ্যাল করে সঞ্জীবের দিকে দেখছিলাম| কি বলব? আবছা আবছা মনে পড়ছিল কাল রাতের কথা... রোমিল, সরপঞ্চ, কাঁকনি, সামন্ত শাসকের সেনাবাহিনী! কুলধারা গ্ৰাম! এরা কেউ বিশ্বাস করবে রোমিলের কথা, বিশ্বাস করবে না যে কালকে আমি এক রাতের জন্য সরপঞ্চের অতিথি হয়েছিলাম| উনি নিজ মুখে কুলধারা সহ আরো তিরাশিটি গ্রামের রাতারাতি জনশূন্য হয়ে যাওয়ার আসল কারণ আমাকে.... কেবল আমাকে বলেছেন ! সবাই শুনে হাসবে... ভাববে আমি হ্যালুসিনেশনের শিকার| বালিতে মুখ গুঁজে পড়ে থেকে পুরো ঘটনাটা আমি হ্যালুসিনেট করেছি| আমি হালকা হেসে‌ ক্লান্ত গলায় বললাম, মনে পড়ছে না আমি ঠিক কিভাবে ওখানে গেলাম‌| আমি আজই কলকাতা ফিরব | 
চেয়ে দেখি আকাশ জুড়ে সূর্যদেব মিটিমিটি হাসছেন, আর সেই সূর্যরশ্মির তেজে ধীরে ধীরে আবছা হয়ে আসছে কুলধারায় কাটানো এক রাত্রের স্মৃতি| হয়ত কিছুদিন বাদে আমিও বিশ্বাস করতে শুরু করব... এটা কেবল আমার হ্যালুসিনেশন ছিল... 

উৎস -  গল্পটি লেখিকার ফেসবুক এর ব্যক্তিগত ব্লগ থেকে নেওয়া হয়েছে। নিচে প্রধান গল্পের লিঙ্ক  রইল ।



আপনি যদি আপনার লেখা আমাদের ওয়েবসাইট এ প্রকাশ করতে চান , তাহলে আপনার গল্প আমাদের গ্রুপ এ পোস্ট করুন । 

সাহিত্য মেলা ফেসবুক গ্রুপ 

https://www.facebook.com/groups/sahityomela


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

close