বিড়ি - সুমন সেন



বিড়ি 

©সুমন সেন


                বাড়ীর প্রত্যেকটা কোন তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখলো চাঁদু বাবু । না ! কোথাও নেই! একবার পুরানো ব্যাগগুলো দেখি। যদি ভুল বসত থেকে গিয়ে থাকে। ধুর! ব্যাগগুলোতেও নেই। এবার কি শেষমেষ পাড়ার ওই মাতব্বর বুড়ো গুলোর কাছে চাইতে হবে?!! কিন্তু সমস্যা হলো ওদের তো আবার পেটে কথা থাকে না।পাড়াময় রটিয়ে বেড়াবে বিখ্যাত সাহিত্যিক চন্দ্রশেখর ব্যানার্জী এত টাকার মালিক হয়েও, শেষে কিনা বিড়ি খায়?!
চাঁদুবাবুর ওই এক নেশা সারাদিন ৩ বান্ডিল বিড়ি নাহলে ঠিক লেখা বেরোয় না।বুদ্ধির গোড়ায় ভালোমতো ধোঁয়া না পড়লে কি আর এত দামী দামী লেখা বেরোত। ওরা আর এসবের কি বুঝবে!যতসব মুখ্য সুখ্য লোক।ওদের তো আড্ডা মারা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই।করতো আমার মতো মাথা খাটানোর কাজ, তাহলে বুঝতাম। পাড়ার সব দোকান অনেক দিন ধরেই বন্ধ।একমাত্র বাজারে গেলে হয়তো দোকান খোলা পাবো। এই ভেবে ঔষধের প্রেসক্রিপশনটা নিয়ে বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।
             
                        ©সুমন সেন
                 একটা বিদঘুটে ভাইরাস এর থেকে বাঁচতে সরকার মহোদয় চারিদিকে সব বন্ধ করে দিয়েছে। মনে ওই Lockdown  । বিদঘুটে ভাইরাসটার নাম নাকি "করোনা" । ভীষণ ছোঁয়াচে রোগ। সারা বিশ্বে এই ভাইরাস এক ভীষণ মহামারী সৃষ্টি করেছে। এই মহামারী থেকে বাঁচতেই নাকি Lockdown ।
খবর দেখে এই তথ্য গুলো চাঁদু বাবু জোগাড় করেছেন। এমনকি বিশ্বের তাবড় তাবড় সংস্থাও নাকি "Work From home" করাচ্ছে। অবশ্য তাঁতে চাঁদু বাবুর কিছু যায় আসে না। কারণ তিনি তো সারা বছরই work from home করে চলেছেন। সমস্যা শুধু একটাই, তার কাছে বিড়ির সাপ্লাই নেই!
           চাঁদু বাবুর বাড়ির থেকে প্রায়৫ কিমির মধ্যে কোনো বাজার নেই। কারণ তিনি যেখানে থাকেন সেই গ্রামের চারপাশে জঙ্গলে ঘেরা। অনেক অসুবিধা থাকলেও এত সুন্দর পরিবেশ যে কোনো লেখকদের জন্য স্বর্গ। কিন্তু আজ একটু কষ্ট হচ্ছে, এতটা পথ পায়ে হেঁটে যেতে হবে। আগে দুএকটা গাড়ি এদিক দিয়ে যেতো, কিন্তু এখন তো সবই বন্ধ। কাজেই হেঁটে যাওয়া ছাড়া গতি নাই। একটা গল্পের প্লট ভাবতে ভাবতে হাঁটা শুরু করলেন। ভাবতে এতটা বিভোর হয়ে গেলেন যে কখন যে জঙ্গল পেরিয়ে বাজার এর কাছাকাছি চলে এসেছেন বুঝতেই পারেননি, সামনের দুটো ব্যাক পেরোলেই বাজারে পৌঁছে যাবেন। হটাৎ  মনে পড়ল টিভিতে দেখা পুলিশের প্যাঁদানির কথা। বিনা কারণে রাস্তায় বেরুলেই নাকি এই মহৌষধ ব্যাবহার হচ্ছে। যদিও এই বিপদ থেকে বাঁচতেই প্রেসক্রিপশন টা আনা। শেষের ব্যাক টা পেরিয়ে ভয়ে ভয়ে চারিদিক দেখে নিলেন কোথাও পুলিশ আছে কিনা। কেউ নেই দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে যেইনা বাজারে ঢুকতে যাবেন, ওমনি খাঁকি পোশাক পরা দুটো লোক দৌড়ে এসে বলল - এই সময় বাজারে এসেছেন কেন? মাস্ক কোথায়?
চাঁদু বাবু কাঁচুমাচু হয়ে বললেন - আ... আজ্ঞে দুটো ঔষধ কিনতে এসেছি।
-- কই দেখি তো প্রেসক্রিপশন টা!
কাগজটা বাধ্য ছেলের মতো এগিয়ে দিলেন চাঁদু বাবু। কাগজটা দেখেই ওদের একজন বলল- "এই সময় পুলিশের সাথে চাংরামী !!! বলেই দড়াম করে একটা লাঠির বারি কষিয়ে দিলো। তারপর কাগজটা হাতে গুঁজে দিয়ে বলল- চুপ চাপ বাড়ি চলে যান। একদম এমুখো হবেন না।
-- কিন্তু ওষুধ টা....!!!
--- তবেরে !! বলে পুলিশ টা যেই না লাঠি তুলেছে, অমনি চাঁদু বাবু পিছন দিকে জোরে দৌড় লাগলেন। অনেক দূরে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে কাগজটা খুলে দেখেন যে তিনি প্রেসক্রিপশন এর বদলে প্রেম পত্র নিয়ে এসেছেন।  গতমাসে তাঁর এক অনুরাগিনী তাঁকে এই চিঠি খানা পাঠিয়ে ছিলো। মনে মনে নিজের উপর খুব রাগ হলো। এতবড় মানুষ হয়েও একটা প্রেসক্রিপশন ঠিক ঠাক আনতে পারেননি। ছিঃ... ছিঃ ছিঃ.. ছিঃ।পুলিশের প্যাঁদানি খেয়ে লজ্জায় চাঁদু বাবু বাড়ি ফিরে এলেন। ভাবলেন পাড়ার কোনো ছেলেকে দিয়ে আনিয়ে নেবেন।
            ©সুমন সেন
              গত দুদিন ধরে চাঁদু বাবু লেখার কাজে একদম মন বসাতে পারছেন না। একেইতো মহৌষধী বিড়ি নাই, তার উপরে কে যেন রোজ রাতে বাড়ির পিছনের জঙ্গলে এসে বিড়ি খাচ্ছে ।যার গন্ধ সোজাসুজি চাঁদু বাবুর ঘরে ঢুকছে। আর নাকে গন্ধ এলে যে খাওয়ার নেশা যে ৪ গুন বেড়ে যায় ,সেটা বোধহয় আপনারা সবাই জানেন। চাঁদু বাবু ভাবলেন কোন বদমাশ ছোড়া তাকে বিরক্ত করতে হয়তো এই কাজ করছে। তারপরেই ভাবলেন .. উহুহু .. পাড়ার কেউতো জানেই না যে তিনি বিড়ি খান কিনা। আজ একবার ওখানে গিয়ে দেখবেন । যথারীতি খাওয়া দাওয়া করে অপেক্ষা করতে লাগলেন। ঠিক রাত ১২.১৫ কি ১২.২০ হবে তখন আবার সেই বিড়ির গন্ধটা আসতে শুরু করলো। তাড়াতাড়ি বেরোতে গিয়ে টর্চটা নিতে ভুলে গেলেন। জঙ্গলে আন্দাজ করে কিছুটা এগোতেই দেখলেন সাদা ধুতি পড়া কুচকুচে কালো শীর্ণকায় লোক আম গাছ তলায় বসে সুখটান দিচ্ছে। চাঁদু বাবু একটু জোরেই বললেন - কে ওখানে ?
-- আজ্ঞে আমি ও পাড়ার নফুর। কাম কাজ নেই তাই রাত বিরেতে শিকার ধরে খাই।
চাঁদু বাবু কিছুটা নিশ্চিন্ত হলেন । মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল।  ভাবলেন যাই হোক এ তাহলে আমায় চিনবে না। তাহলে এই সুযোগে ওর থেকে দুচারটে বিড়ি চেয়ে নেওয়া যাবে। বললেন-- ওঃ! গত দুদিন কি তুই ই এখানে এসে বিড়ি টানছিলি?
-- আজ্ঞে হাঁ।আমাদের পাড়ার সব শিকার সতর্ক হয়ে গেছে। কেউ ফাঁদে পা দিচ্ছে না। তাই এই পাড়ায় এলুম।
চাঁদু বাবু বললেন -- হুমম, বুঝলাম। তা হ্যারে তোর কাছে তো বিড়ি আছে..  আমায় দু একটা দেতো । অনেক দিন খাওয়া হয় না।
এক অদ্ভুত হাঁসি হেসে নফুর বললো--  হি... হি... হি... বিড়ি খা..বেন বাবু? কিন্তু এই বিড়ির খাওয়ার মুল্য কিন্তু অনেক। আপনি সহ্য করতে পারবেন না। দুটো টান....... তার পর সব শেষ..... হি হি হি.... মনে হবে যেন হাওয়ায় উড়ছেন.. . তার পর কিন্তু আর কোনো দিনই বিড়ি খাওয়ার নেশা থাকবে না।
         
           লোকটার হাসিটা কেমন যেন বিদঘুটে। কেমন যেন খনা গলায় কথা বলছে। ভুত টুত নয়তো ??? দূর..... এখানে ভুত আসবে কোথা থেকে! নফুরের বাড়িয়ে দেওয়া শীর্ণকায় দুটো বিড়ি তুলে নিয়ে ,একটা পকেটে রেখে আর একটা ধরিয়ে যেইনা সুখটান দিয়েছে ওমনি চারপাশের সবকিছু কেমন যেন বদলে যেতে শুরু করলো। পায়ের নিচের মাটি বনবন করে ঘুরতে ঘুরতে চাঁদু বাবুকে আকাশের একদম কাছে নিয়ে চলে গেল। মনে হচ্ছে যেন তারা গুলোকে হাত দিয়ে ধরে ফেলবে । পুরো বিশ্বটাকে যেন 3D সিনেমা হল মনে হচ্ছে। উফফ.. কি অপুর্ব এই সুখ.. এমন সুখ প্রতিদিন পেতে চাই।  এই খুশিতে দিলেন বিড়িতে দ্বিতীয় টান... চাঁদুবাবু অনুভব করলেন নিজেকে অনেক হালকা লাগছে এবার ডানা মেলে দিলেই উড়ে যাবেন। তৃতীয় টান  দিতে গিয়ে দ্যাখেন তাঁর হাত ফাঁকা।। অদ্ভুত ভাবে বিড়ি খাওয়ার ইচ্ছা টাও কেমন জানি উড়ে গেছে। ঘাড় ঘুরে নফুর এর দিকে তাকাতেই চাঁদুবাবুর দমবন্ধ হয়ে আসতে লাগলো.. ..... কি বীভৎস দৃশ্য নফুর চাঁদুবাবুর শরীর থেকে একটু একটু করে মাংস খুবলে খুবলে খাচ্ছে । তাঁর দুগালের চোয়াল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে তাজা রক্ত। এবার সে মুখ তুলে চাঁদুবাবুর দিকে তাকিয়ে বিদঘুটে হাঁসি হাসতে হাঁসতে  বলল------------ "" শি......কা......র""



 ©সুমন সেন

এই গল্পের উপর একটি অডিও স্টোরি ইউটিউব এ রয়েছে । তার লিঙ্ক নিচে দিলাম 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

close