নিমপীঠএর ছাত্রদের স্বাধীনতার দিন - কলমে সুমন সেন


নিমপীঠএর ছাত্রদের স্বাধীনতার দিন  

সুমন সেন 

প্রকৃত স্বাধীনতা দিবস বলতে নিমপীঠ আশ্রমের ছাত্রদের কাছে ছিল স্বরসতী পূজার দিন টা।আমাদের কমিউনিটি হলে ( অর্ধেক বেদনার মত দেখতে ) বিশাল আকৃতির দেবীর পূজা হতো, আমাদের ঘাড়েই পরতো সমস্ত পূজার দায়িত্ব। ঠাকুর আনা থেকে, হল সাজানো , পূজার জিনিস পত্র জোগাড় করা, বেশির ভাগ সময়ে আমাদের মন্দিরের পূজারী স্বামীজি পূজা করতেন, তবে আমার হোস্টেল জীবনের শেষের দিকে পাহাড়ী স্যার পূজার দায়িত্ব নিয়ে ছিলেন। সমস্ত ছেলেরা অপেক্ষা করত কবে সেই দিনটা আসবে। পাঠকরা জেনে রাখুন এই অপেক্ষা কিন্তু মা কে পূজা করার আনন্দে ছিল না, এটা ছিল কয়েক ঘণ্টার জন্য সমগ্র নিমপীঠ চত্বরে বিনা বাধায় ঘুরে বেড়ানোর জন্য। আর সেই কয়েক ঘণ্টা মুক্তির যে আনন্দ আমরা উপভোগ করতাম তা বর্তমানে পাওয়া যেকোনো খুশির সামনে তুচ্ছ। যাইহোক বাকিটা পারে বলছি। ওই দিন কি কি করা হবে আমরা আগের দিন রাতেই প্রি প্লান করে রাখতাম, অঞ্জলী দেওয়ার পর কোন রাস্তা দিয়া কোথায় কোথায় যাওয়া হবে এবং কে কার বান্ধবীর সাথে দেখা করবে কোন সময়ে । বান্ধবী স্বত্তা ধরি রা বেশ কয়েকদিন আগেই চিঠি মারফত খবর পৌঁছে দিতে তাদের বান্ধবীদের কাছে। তারপর যথা সময়ে তাদের মিলন ঘটতো।

            যাইহোক ভোর 4.30 তে উঠে প্রার্থনা করে এসে আমরা দৌরতাম স্নান করতে। গিয়া দেখতাম পুঁচকে গুলো লম্বা লাইন দিয়া পর পর স্নান করতে ব্যাস্ত, নিয়ম মত  আমাদের ও লাইন দিয়া স্নান করা উচিত । কিন্তু না আমার তো হোস্টেল এর দাদা ছিলাম তাই VIP  নেতা দের মত লাইন সরিয়ে দিয়ে চলতো আমাদের স্নান , কেউ কোনো কথা বলতে পারতো না বললেই তো.........................  । তবে হ্যাঁ এই অত্যাচার ছিল কেবল একদিনের জন্যই কারণ তারাতারি না বেরোলে সময় টা যে কম পড়বে। যথারীতি স্নান সেরে ধুতি পাঞ্জাবি পরে 4-5 জন একসাথে বেরোনো হলো পায়ে হেঁটে প্রতিবেশী দেশের এলাকা পরিদর্শনে। তবে শুধু এলাকা পরিদর্শন ই নয় মূল উদ্দেশ্য থাকতো শাড়ি পরা দেবী দর্শন এবং দুএকটা শব্দ বান প্রয়োগ করা। শিশু মন সর্বদা স্রোতের বিপরীতে যেতে পছন্দ করে,তাই আমরাও ভিন্ন ছিলাম না।তখন ক্লাস নাইনের ছাত্র, ওই দিন মা এলেন দেখা করতে। দীর্ঘ ১ মাস পর মা দেখা করতে এসে ছিলেন ,সবারই মন চায় যতক্ষণ পারাজায় তার সাথে সময় কাটাতে, কিন্তু ওই যে ওটা তো আমাদের স্বাধীনতার দিন তাই ছট্ফট্ করতে থাকলাম কখন মা বাড়ী যাবে আর আমরা ঘুরতে বেরোব। আমার ছোটফটানি দেখে মা জিজ্ঞেস করলো "  অন্য দিন তো ছারতে চাস না আজ কি এমন হলো??  " শেষে বাধ্য হয় মাকে ঘোরার কথা বললাম । মা বললো " চল আমিও তোদের সাথে যাবো। " ব্যাস আমার মাথায় তো আকাশ ভেঙে পরলো, ভাবলাম এবছর আমাদের ঘোরা মাটি হয়ে গেল।  অগত্যা সবাই কে গিয়ে জানালাম। সন্দ্বীপ র দুএকজন ও রাজি হলো। সবাই মিলে বেরোলাম দর্শন করতে। আমরা তো দেবী দর্শন আর একে ওপরের দিকে চোখ টিপে ইশারা করছি, মা খেয়াল করছিল কিনা জানি না। কিছু দূর যাওয়ার পর আমরা লক্ষ্য করলাম বেশ সুন্দরী একদল বালিকা রাস্তার ওই দিক থেকে আসছে, কাছে আসতেই আমাদের সবাইকে চমকে দিয়ে মা বলল " তোরা কি রে সন্দ্বীপ ! রাস্তায় বেরিয়ে   এত সুন্দর সুন্দর জ্যান্ত স্বরসতী দেখবি কোথায়? টা না করে মাথা নিচু করে হাটছিস, এত লজ্জা টি মেয়েরাও পায়না। আমার ছেলেটার তো কিছুই হবে না , তাবলে তুই কি ওর মতই হবি। "" আমি নিজের কাজ কে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমার মা প্রচন্ড রাগী বলেই জানতাম কিন্তু ওনার এই রূপটা সম্পূর্ণ অন্য। কিছু লজ্জায় পরেই সন্দ্বীপ এর দিকা তাকালাম দেখলাম ওর ও অবস্থা একই রকম।

তারপর আর অসুবিধা হয়নি ,  সামনে থেকে আসা এক একজনের বর্ণনা মা নিজেই সোনাতে থাকলো আর সন্দ্বীপ সায় দিতে থাকলো , আর আমি তো লজ্জায় পাগল হতে থাকলাম। সবশেষে মা আমাদের হোস্টেলে ছেড়ে দিয়ে বাড়ি চলে যেতেই আমরা হাফছেরে বাঁচলাম। কিন্তু ওই দিনের ঘটনা আমাদের অনেক স্মৃতি র খুশির খোরাক দিয়েছিল। দিনের শেষে দেখতাম বান্ধবী স্বত্বাধিকারী রা ঠিক সন্ধ্যা হওয়ায় আগে উপস্থিত হতো। তার পর চলত সারাদিনের কর্ম কাণ্ডের আলোচনা। কে  কিভাবে লুকিয়ে দেখা করে মহান কাজ করছে, চলত  তাদের সেই মহান  বীরত্বের গাথা। তবে সেদিনের শেষ টা কিন্তু আমাদের ভালো যেত না। প্ল্যান করেও অনেককিছু না করতে পারা অনুশোচনা আমাদের বরাবর  কষ্ট দিয়েছে । 
আর  সঙ্গে যুগিয়ে গিয়েছে   আরও এক বছর অপেক্ষা করার ধৈর্য ।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

close